আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, এদেশে আমাদের বিদ্রোহাগ্নি জ্বালাতে হবে। আমরা এক গুপ্ত আন্দোলনের দাবানল সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। তোমার হয়ত অজানা নয় যে, যে দেশে বাদশাহর বিরুদ্ধে অত্যুত্থান হয় সে দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে রক্তপাতের সৃষ্টি হয়। যদি বাদশাহ যিরাবের মত সংগীতজ্ঞ আর তোমার মত ভুবনমোহিনীর রূপে মোহাচ্ছন্ন থাকে, আর তার অধীনে সুদক্ষ সেনাবাহিনীও থাকে তাহলে তারা কমযোর হয়ে পড়বে অতি অবশ্যই। তুমি তোমার রূপের যাদুতে স্পেনরাজকে কাবু কর। তাকে তোমার নারী সুষমায় রাজ্য ও প্রতি-আক্রমণের কথা ভুলিয়ে দাও।
বুঝেছ সুলতানা। কি বলছি আমি। আমরা আবদুর রহমানকে জীবিত রাখতে চাই। তবে তার পৌরুষবহুল বীরোচিত ভেতরটা ভোলা বানিয়েই। এ কাজ খুব একটা সহজ নয়। এজন্য তোমার এনাম এত বিশাহু-বিশাল এক প্রদেশ, যার কর্ণধার হবে তুমি। থামল এলোগেইছ।
***
এলোগেইছ যে গুপ্ত আন্দোলনের প্ল্যান বয়ান করছিল তা কেবল ঔপন্যাসিক গল্প নয়- এই প্ল্যান বাস্তব। এলোগেইছ-ই যার পথিকৃত। স্পেনের মুসলিম শাসকদের গ্রানাডাচ্যুত করার প্রথম অধিকর্তা এই লোকই। কুদরত তাকে দিয়েছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞা ও মেধা। ধর্মজ্ঞানে সুপন্ডিত আর কূটনৈতিক ময়দানে সুদক্ষ সেপাই। সে আরবী ভাষা রপ্ত করেছিল এবং কুরআনের মানে মতলব বুঝতে শিখেছিল। স্পেনের প্যালোনায় খ্রীস্টানদের ইবাদাতগাহ ছিল। ওখানে একটি বই উদ্ধার করা হয়, যাতে বিশ্বনবী সম্পর্কে কুৎসা লেখা ছিল।
এ বইতে অনেক বইয়ের রেফারেন্স ছিল। এলোগেইছ এর কপি নকল করে গীর্জায় বিলি করে ও পাদ্রীদেরও নকল করে বিলি করতে বলে। সুতরাং ইসলামের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা পুরোদস্তুর চলতে থাকে। মুসলমান প্রশাসক যারা আমীর বা গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত ছিল তাদেরকে বাদশাহ আখ্যা দেয়া শুরু হল। তারা জানলনা ইসলাম ও ইসলামী সাম্রাজ্য নিয়ে চলছে কি ষড়যন্ত্র।
এলোগেইছ শহরে শহরে ঘুরে অবশেষে ফ্রান্সে গিয়ে উপনীত হল। ইসলামী সাম্রাজ্যের শেকড় কাটা ও মুসলিম শাসন ধ্বংসের মিশন বানাল সে। তার এ আওয়াজ গীর্জা ও খ্রীস্টান বাড়ী বাড়ীতে পৌঁছে গেল যে, ধর্ম-কর্ম ছেড়ে দিলে আগামী বংশধরও মুসলমানদের গোলাম হয়ে যাবে। ধর্মের ঝান্ডাবাহীরাই বর্তমান সময়ে ধর্মের রক্ষাকর্তা। মুসলমানদের নৈতিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। তাদের শাসক মহলে নূপুর, নিক্কণ ও নারী বিলাসিতা জেঁকে বসেছে। হৃদয়ে প্রগাঢ় হয়েছে ক্ষমতালোভ। ওরা জাতিকে এক্ষণে ধোকা ও প্রতারণা দিয়ে চলেছে। ওদের সেই অজেয় সমর চেতনা লোপ পেয়ে গেছে যার বদৌলতে এক সময় অর্ধ দুনিয়া শাসন করেছে। ওদের বাদশাহরা জাতিকে এমন স্থানে নিয়ে গেছে যেখানে কোন তারিক বিন যিয়াদ পয়দা হবে না। এ জাতি এমন সন্তান পয়দা করতে অপারগ। ওদের বধূ-মাতারা বন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন থেকে কর্তৃত্ব হবে ঈসা মসিহর। শাসন হবে ক্রুসেডের।
এলোগেইছের এই আন্দোলনকে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা বলে। কপটচারিতা বলেও অনেক ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন। আরবীতে একে মোয়াল্লেদীন বলে। মোয়াল্লেদীন ঐসব খ্রীস্টানদের বলে, যারা মুসলিম শাসনের যবনিকাপাতের স্বার্থে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের অধিকাংশই কর্ডোভা, টলেডো ও মালাকাবাসী।
এরা এলোগেইছের মত নেতা পেয়ে খ্রিস্টধর্মে প্রত্যাবর্তন না করে মুসলমান থেকেই ইসলামের শেকড় কাটতে থাকে। ইতিহাস লিখেছে, ওরা মসজিদে নামায আদায় করত। দেখতে পাকা মুসল্লী, কিন্তু তলে তলে পাক্কা খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের আস্তিনের সাপ। ইসলাম বিরোধী চেতনা ছাড়াও আরবদের ব্যবহার ওদের হতাশ করে দিয়েছিল। আরবজাতি এই নও মুসলিমদের ঘৃণার চোখে দেখত। অথচ কুরআন ও ইসলামী ভাবধারা মোতাবেক ওদের প্রকৃত আরবদের মতই পজিশন লাভ করার দরকার ছিল, কিন্তু বাস্তবে ছিল এর উল্টো।
এলোগেইছ আরেক সতীর্থের সন্ধান পেয়েছিলেন। আইলিয়র তার নাম। এরা দুজনই জনৈক ঈসায়ী ধর্মপ্রচারক শীর-এর শাগরেদ। ওদের এই বস একটি ইসলাম বিরোধী বই লিখেছিলেন।
দ্বিতীয় আবদুর রহমানের যুগে মুসলিম চেতনাকে বিনাশ করার জন্য যখন এহেন ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছিল তখন তিনি মিউজিকের ধুম-ধাড়াক্কা ও নারীদেহ নিয়ে মেতে ছিলেন।
***
তুরুবের রাণী সুলতানা আব্দুর রহমানকে বলেছিলেন যে, দুতিন দিনের মধ্যে ফিরে আসবেন। যে উদ্দেশ্যে তিনি গিয়েছিলেন তা প্রথম দিনেই সমাধা হয়ে যায়। মাত্র এক রাতই জায়গীরে অবস্থান করেছিলেন। এটি তার জীবনের এক স্মরণীয় রাত। এলোগেইছের যাদুকরী প্ল্যান আর তার যৌবনদীপ্ত চেহারা সুলতানাকে আকর্ষণ করে। সুলতানার মনে দাগ কাটে। তাছাড়া তিনি এলোগেইছের সাথে এজন্য ভাব রাখতে চান। যাতে নয়া প্রদেশ পেয়ে যান।
এলোগেইছ রাতে আলাদা কামরায় থাকল। মাঝরাতে কারো হস্তস্পর্শ ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ গেল খুলে। দ্রুত সে কোমরে গোঁজা ছোরায় হাত বুলাল। সুলতানা কথা বলে না ওঠলে তার ছোরা সমূলে বিদ্ধ হত বুকে। এলোগেইছ বলে উঠল, সুলতানা! কি সংবাদ নিয়ে এলে?
সংবাদ নয় তোমার পৌরুষে টোকা মারতে এসেছি। সুলতানা আধো ঘুম অবস্থায় নিজের শরীর এলোগেইছের দেহে লীন করে দিয়ে বলল, যে কথা তুমি বলতে চাওনি তা আমি বুঝতে পেরেছি। নিজকে এভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে কেন এলোগেইছ?