শিবিরের উপর নজর রাখতে গিয়ে টারজনের হঠাৎ মনে হল, এই দস্যুরা যেমন তার মুখের গ্রাস হরিণটাকে হাতছাড়া করে দিয়েছে, তেমনি সেও ওদের কাছ থেকে একটা কিছু হরণ করবে। একথা ভাবতে গিয়েই তার মনে হর, আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ওই সাদা মানুষটাকে চুরি করতে পারলেই তো ব্যাটাদের বোকা বানানো যায়।
গাছের ছায়ার আড়ালে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল টারজান। কতক্ষণে দস্যুরা গভীর ঘুমে ঢুলে পড়বে, কতক্ষণে তাদের শিকারকে নিয়ে সে পালাতে পারবে-তারই অপেক্ষা। এক সময় নুমা’র তীব্র গন্ধ তার নাকে এল। অবশ্য সে ভালভাবেই জানে, ঘোড়ার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে নুমা’ শিবিরের কাছে এলেও যতক্ষণ আগুনটা ভালভাবে জ্বলতে থাকবে ততক্ষণ সে কিছুতেই শিবিরে ঢুকবে না।
শেষ পর্যন্ত এক সময় সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল। শাস্ত্রীও ঘুমে ঢুলছে। ছায়ার মত নিঃশব্দে টারজান গাছ থেকে নেমে এল।
ক্রমেই সে শাস্ত্রীটি আরও কাছে এগিয়ে চলল। এবার ঠিক তার পিছনে। একটা কঠিন হাত দ্রুত বেরিয়ে এল, ইস্পাত-কঠিন কয়েকটা আঙুল চেপে বসল শাস্ত্রীর বাদামী গলায়, আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ছুরি আমূল বিদ্ধ হল তার বাঁ কাঁধ থেকে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত।
অসাড় দেহ থেকে টারজান ছুরিটা তুলে নিল; তারপর এগিয়ে চলল বন্দীর দিকে। সে খোলা জায়গাতেই শুয়ে আছে। নিভন্ত আগুনের অস্পষ্ট আলোয় দেখতে পেল বন্দীর চোখ দুটি ফোলা; সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সে টারজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের উপর আঙুল তুলে টারজান তাকে চুপ করে থাকতে বলল। হাঁটু ভেঙে তার পাশে বসে হাত-পায়ের শক্ত চামড়ার দড়ি কেটে দিল; টারজান তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল।
মুহূর্তকাল পরেই সে ইসারায় বন্দীকে বলল তাকে অনুসরণ করতে। কিন্তু দস্যুরাও স্থির সংকল্প-তাদের কিছুতেই পালাতে দেবে না। বন্দুকের কুঁদো ও বর্শা বাগিয়ে তারাও রুখে দাঁড়াল। অরণ্যের রাজ ও তার সঙ্গী বুঝল, অবস্থা বড়ই সঙ্গীন।
একজন দস্যু এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যেখান থেকে সঙ্গীদের কোন বিপদ না ঘটিয়েই গুলি ছোঁড়া যায়। গাদা বন্দুকটা কাঁধের উপর তুলে সে টারজনের দিকে নিশানা স্থির করল।
টারজানকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়বার জন্য লোকটা সবে বন্দুকটা কাঁধের উপর তুলেছে এমন সময় অপর এক দস্যু সহসা আর্তনাদ করে উঠল, আর সে আর্তনাদকে ছাপিয়ে শোনা গেল সিংহ নুমার গর্জন; এক লাফে সে এসে হাজির হল শিবিরের মাঝখানে।
যে দস্যুটি টারজানকে গুলি করতে উদ্যত হয়েছিল সে একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে সিংহটাকে দেখেই ভয়ে চীৎকার করে উঠল। উত্তেজনাবশে রাইফেলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সিংহের থাবা থেকে পালাতে গিয়ে ছিটকে পড়ল টারজনের হাতের মধ্যে।
টারজানও পলায়নমান দস্যুটাকে দুই হাতে মাথার উপর তুলে নুমার মুখের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। নুমাও সঙ্গে সঙ্গে বিরাট হা করে হতভাগ্য লোকটির মাথা ও গলা ঢুকিয়ে দিল মুখের ভিতরে। এদিকে টারজানও সঙ্গীটিকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত করে এক ছুটে সিংহটাকে পাশ কাটিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল গাছের সেই দো-ডালায় যেখান থেকে নুমা লাফিয়ে নেমে এসেছিল। শ্বেতকায় বন্দীটিও সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু নিল। সিংহের আকস্মিক আবির্ভাবে হতচকিত দস্যুরা সঠিক বুঝে ওঠার আগেই সাদা মানুষ দুটি রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দিনের পর দিন দুটি মানুষ বিরাট এক পর্বতমালার গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করতে লাগল। দীর্ঘদিন ধরে এক সঙ্গে চলাফেরার সুযোগে সে সঙ্গীর ভাষাটি আয়ত্ত করতে সচেষ্ট হল।
টারজান প্রথমেই জেনে নিল যে তার সঙ্গীটির নাম ভালতোর, আর ভালতোর গোড়া থেকেই টারজনের অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগল। সঙ্গীটি নিরস্ত্র হওয়ায় টারজান তার জন্য একটা বর্শা ও তীর-ধনুক তৈরি করে দিল। তারপর থেকেই ভালতোর জঙ্গলের রাজাকে শেখাতে শুরু করল তার ভাষায় কথা বলতে, আর টারজান শেখাতে লাগল ধনুর্বিদ্যা।
এইভাবে অনেক সপ্তাহ কেটে গেল, কিন্তু ভাল্তোরে দেশটা তখনও যে দূরে সেই দূরেই রয়ে গেল। পাহাড়ে শিকারের অভাব নেই, তাই খাদ্যের কোন সমস্যা নেই।
কিন্তু ভালতোরের অত ধৈর্য নেই; অবশেষে একদা দিন শেষে পথরোধকারী একটা সুউচ্চ পাহাড় প্রাচীরের সামনে পৌঁছে সে অসংকোচে বলল, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমরা কি করব?
যে শিবিরে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল সেখান থেকে তোমার দেশটা কোন্ দিকে বলতে পার? টারজান শুধাল।
ভালতোর জবাব দিল, সেখান থেকে থেনার সোজা পূর্ব দিকে; সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
টারজান আশ্বাস দিয়ে বলল, পূর্ব দিকে আমি ঠিকই যেতে পারব, কিন্তু ঠিক আমাদের পথের উপর না পড়লে তো তোমার দেশটাকে আমি চিনে নিতে পারব না।
ভালতোর বলল, আমরা যদি সে দেশের পঞ্চাশ বা একশ’ মাইলের মধ্যে পৌঁছতে পারি তাহলে কোন উঁচু জায়গা থেকে জারাটরকে আমরা দেখতে পাবই। সেখান থেকে থেনারের পথ আমি চিনতে পারব, কারণ এথনি শহরটা জারাটর থেকে প্রায় খাড়া পশ্চিমে।
জারাটর ও এথনিটা কি? টারজান জানতে চাইল।
জারাটর একটা বিরাট পর্বত-শিখর; তার কেন্দ্রস্থল অগ্নি ও গলিত পাথরে পরিপূর্ণ। সেটা ওথার উপত্যকার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত; স্বর্ণশহর কাথুনির লোকরাই সেটার মালিক। আমি নিজে গজদন্তের শহর এথনির অধিবাসী। ওনার উপত্যকার অন্তর্গত কাথুনির অধিবাসী আমাদের চিরশত্রু।