তাহলে শেষ পর্যন্ত তাই ঘটল। দু’দিন যাবৎ এই ভয়ই সে করছিল। দলের অন্য সকলের মুখেই সে দেখেছে চাপা ঘৃণার প্রকাশ। সেই একই ঘৃণা ফুটে উঠেছে এই লোকটির চোখে।
খাটিয়ার পাশে রাখা খাপ থেকে রিভলবারটা বের করে মেয়েটি বলল, বেরিয়ে যাও; নইলে তোমাকে মেরে ফেলব।
লোকটি এক লাফে তার দিকে এগিয়ে এল। মেয়েটি গুলি ছুঁড়ল।
একটা প্রকাণ্ড গাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে একটি মানুষ। তার এক বগলে শীতে কুঁকড়ে গায়ের সঙ্গে কি একটা যেন লেপটে রয়েছে। লোকটি মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথা বলছে; অন্য হাত দিয়ে আদর করছে। দেখে মনে হয় তার ছেলে বুঝি। কিন্তু তা নয়, একটা ছোট বানর। বাতাসের প্রতিটি ঝাঁপটা, বিদ্যুতের প্রতিটি ঝলকানি, আর বর্জ্যের প্রতিটি হুংকারের সঙ্গে সঙ্গে সে কেঁপে কেঁপে আরও কুঁকড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝড়ের দাপট চরমে উঠল। যে গাছের নিচে তারা আশ্রয় নিয়েছিল সেটা ভেঙে পড়ল। বিড়ালের মত লোকটা এক পাশে লাফিয়ে পড়ল। বানরটা ছিটকে পড়ল বেশ খানিকটা দূরে। কিন্তু একটা মোটা ডাল এসে লাগল লোকটার মাথায়; সে মাটিতে পড়ে গেল; ডালটা তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলল।
ঝড় থেমে গেল। বানরটা মনিবকে ডেকে ডেকে অনেক খুঁজল। অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। তারই মধ্যে এক সময় গাছের নিচে খুঁজে পেল মনিবকে, নিশ্চল ও নিষ্প্রাণ।
কিল্লু গ্রামের ছোট দলটির প্রাণ-পুরুষ ছিল নিয়ামওয়েগি। নিজের গ্রাম টুম্বাই থেকে সে সেখানে গিয়েছিল একটি কৃষ্ণা সুন্দরীর পানি গ্রহণ করতে। মনের ফুর্তিতে চলতে চলতে খেয়ালই ছিল না; হঠাৎ এক সময় নেমে এল নিরক্ষবৃত্তাঞ্চলের রাত।
সৈনিকটি নিঃশব্দ পদক্ষেপে টুম্বাইয়ের পরিচিত পথ ধরে চলতে লাগল। সঙ্গে বর্শা ও ঢাল; কোমরে ঝুলছে লম্বা ছুরি। তার গলার তাবিজটা অনেক শক্তি ধরে। মাঝে মাঝেই সেটাতে আঙুল ঝুলিয়ে সে। তার কূল-দেবতা মুজিমোর স্তব করছে।
অর্ধেক পথ পার হবার পরেই হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন তাকে আক্রমণ করল। তার ধারালো নখর বসে গেল তার কাঁধের মাংসের মধ্যে। যন্ত্রণায় ও আতংকে আর্তনাদ করে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে আক্রমণকারীদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল। কাঁধের উপর থেকে থাবাটা সরিয়ে ছুরিটা বের করতেই আবার বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল, আর সেই আলোয় তার চোখে পড়ল চিতাবাঘের মুখোশে ঢাকা একটা মানুষের বীভৎস মুখ।
নিয়ামওয়েগি অন্ধকারেই আবোল-তাবোল ছুরি চালাতে লাগল; সেই লোকটি পুনরায় পিছন থেকে নখর বসিয়ে দিল তার বুকে ও পেটে; পিছন থেকে সে তাকে জড়িয়ে ধরেছে লোমশ হাত দিয়ে। আবার ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। যে তাকে জড়িয়ে ধরেছে তাকে নিয়ামওয়েগি দেখতে পেল না, কিন্তু দেখতে পেল আরও তিনজনকে-একজন তার সামনের আর দু’জন দুই পাশে। এবার সে আশা ছেড়ে দিল; আক্রমণকারীদের সে চিনতে পেরেছে; চিতাবাঘের চামড়া ও মুখোশপরা এই লোকগুলো চিতা-মানুষদের গুপ্ত সংঘের সদস্য।
এইভাবে উটেনগান নিয়ামওয়েগির মৃত্যু হল।
ঊষার আলো পড়েছে গাছের মাথায়। নিচে টুম্বাই গ্রামের খড়ের ঘরে ঘুম ভাঙল গ্রাম-প্রধানের ছেলে ওরান্ডোর। খড়ের বিছানা ছেড়ে সে বাইরে এসে পথের উপর দাঁড়ালো। যে কূলদেবতার নামে তার নাম রাখা হয়েছে দুই হাত তুলে সেই মুজিমোর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাল।
যে পথ ধরে ওরান্ডো একাকি শিকারে চলল দুই মাইল পর্যন্ত সেটা কিন্তু গ্রামে যাবারও পথ। পরিচিত পথ, কিন্তু আগের রাতের ঝড়ে পথের এত ক্ষতি হয়েছে যে অনেক জায়গায় সে পথে চলাই দুষ্কর। পথের উপর গাছপালা পড়ে থাকায় পথের পাশের ঝোপের ভিতর দিয়ে ঘুরে যাবার পথে একবার তার চোখে পড়ল, একটা ভূপাতিত গাছের ডালপাতার নিচে থেকে মানুষের একটা পা বেরিয়ে আছে।
ওরান্ডো থামল। একটু পিছিয়ে এল। মানুষটা যেখানে পড়ে আছে সেখানকার ডালপালাগুলো নড়ে উঠল। সেখান থেকে মাথা বের করল একটা ছোট্ট বানর।
ওরান্ডোকে দেখে ভয় পেয়ে বানরটা কিচির-মিচির করতে করতে ছুটে গিয়ে একটা বড় গাছের ডালে উঠে পড়ল। ওরান্ডো তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পায়ের দিকেই নজর দিল। সাবধানে অগ্রসর হয়ে ঝুঁকে পড়ে বাকি দেহটা দেখতে চেষ্টা করল।
দৈত্য বিশেষ একটি সাদা মানুষ: চিতাবাঘের চামড়ার কটি-বন্ধনী ছাড়া প্রায় নগ্নদেহ; গাছের একটা ভারী ডালের নিচে চাপা পড়ে আছে। দুটি ধূসর চোখের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ; লোকটি মারা যায়নি।
একটা ছোট ডালের নিচে সে চাপা পড়ে আছে। ওরান্ডো ডালটাকে একটু তুলে ধরতেই লোকটি ধীরে ধীরে উটে দাঁড়াল। দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ছোট বানরটা গাছের ডালে নিরাপদ দূরত্বে বসে মুখ ভেংচে কিচির-মিচির করতে লাগল।
কাজটা ভাল হল কি মন্দ হল বুঝতে না পেরে ওরান্ডো বর্শাটা হাতে নিয়ে নবাগতকে ভাল করে দেখতে লাগল। নবাগতও গাছটার নিচে থেকে ধনুক ও বর্শা তুলে নিল। তার কাঁধে তীরভর্তি তূণীর। অন্য কাঁধে একটা লম্বা, পাকানো দড়ি। কোমরে খাপে ঢাকা ছুরি।
ওরান্ডো কিস্তু গ্রামের পথ ধরেই এগিয়ে চলল। পিছনে নিঃশব্দ পায়ে চলল নবাগত লোকটি। চলতে চলতে আর একটা বানরের গলা শুনে পিছনে ফিরে তাকিয়ে ওন্ডো দেখল, বানরটা বসে আছে লোকটার কাঁধে, আর দু’জনে অনবরত কথা বলে চলেছে বানরদের ভাষায়।