ফলে ইবনে বতুতা যখন ১৩২৫ খ্রীস্টাব্দে সফরে বের হন তখন মুসলিম শাসিত ভূখণ্ডে রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বিশেষভাবে অনুকূল। আসওয়ান থেকে সাইলিসিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত মিসরের সুলতানের হুকুম ছিল অপ্রতিহত। খ্রীস্টান ধর্মযোদ্ধাদের স্মৃতির তিক্ততা মাত্র অবশিষ্ট ছিল এবং মঙ্গোলদের সঙ্গে সম্পর্ক হৃদ্যতাপূর্ণ না হলেও ১৩০৩ খ্রীস্টাব্দে দামেশকে পরাক্রমশালী নাসিরের শেষ বিজয়ের সময় হতে আর কোন যুদ্ধবিগ্রহই দেখা দেয়নি। ইরাক ও পারস্য তখনও মঙ্গোল খানদের শাসন মেনে চলত। খানগণ অবশ্য পুরোপুরি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অবশেষে অল্পদিনের ভেতরেই মঙ্গোল খানদের প্রভুত্বের পরিসমাপ্তি ঘটল। উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সুবর্ণ দলের (Golden herde) ও জাগহাটের (jaghatay) মঙ্গোল খানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। অপরদিকে অসমসাহসিক ও প্রবল পরাক্রান্ত সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশের উপর প্রভাব বিস্তার করছিলেন। বিশাল রাজ্যগুলির প্রান্তভাগে, আনাতোলিয়া ও আফগান প্রভৃতি দূরবর্তী অংশগুলিতে এবং ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় এমন বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সুলতান ও আমীর ছিলেন যারা অপরের প্রভুত্ব স্বীকার করতেন না। বাণিজ্য অথবা জলদস্যুবৃত্তিলব্ধ অর্থে তারা তাঁদের বিপদসঙ্কুল মসনদ টিকিয়ে রাখতেন। ইচ্ছা করলেও তারা সাধারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন ক্ষতিসাধনের ক্ষমতা রাখতেন না। মুসলিম জাহানের সীমান্তের ভেতরে ও বাইরে ব্যবসায় বাণিজ্য অবাধ গতিতেই চলছিল, যদিও কর দিতে হত অত্যধিক হারে এবং সময়-সময় অন্যবিধ অসুবিধাও দেখা দিত। স্থানীয় শিল্পাদির যদিও অবনতি ঘটেছিল বা বিলুপ্তি হয়েছিল তবু ইউরোপীয় বাজার খুলে যাওয়ায় ব্যবসায়-বাণিজ্যের অপ্রত্যাশিত উন্নতি এসেছিল। কারণ, ঐ সকল ব্যবসায়কে তখনও প্রাচ্য সমুদ্রে ইউরোপীয় বণিকদের প্রবল প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করতে হয়নি।
পরবর্তী যুগের মুসলিম সভ্যতার প্রকৃত দুর্বলতা দেখা যায় বিভিন্ন ইসলামিক রাষ্ট্রের মধ্যকার কৃষ্টির অসামঞ্জস্যে। পুরাতন সাম্রাজ্যের পক্ষে ধ্বংস ও বিচ্ছিন্নকারী। শক্তির মোকাবিলা করার অক্ষমতার ভেতরেই এই কৃষ্টিগত বৈষম্যের সন্ধান পাওয়া যায়। দশম শতাব্দীতে মুসলিম কৃষ্টি যখন মধ্যাহ্ন গগনে তখন আটলান্টিক থেকে মধ্য এশিয়ার পর্বতমালা অবধি বিস্তৃত ভূভাগের সর্বত্র মুসলিম কৃষ্টি প্রায় সমভাবে বিরাজমান ছিল। কিন্তু আমরা ইবনে বতুতার পূর্বাঞ্চলের দিকে অগ্রগতির অনুসরণ করলেই দেখতে পাই, কৃষ্টিগত ভূমি তখন কত অনুবর এবং কৃষ্টির মূল কতই না দূর্বল। অথচ এক সময়ে এই কৃষ্টিই মুসলিম সামাজিক জীবন বাঁচিয়ে রেখেছিল এবং বজায় রেখেছিল চতুর্দশ শতাব্দীর রাজ্যগুলির শান-শওকত। আরবদের নিকট উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা পরিচিত ছিল মাগরীব বা পশ্চিম নামে। দ্বাদশ শতাব্দীতে এই মাগরীব মুসলিম অধিকৃত স্পেন সহ একত্র করা হয়েছিল আমোরাভিস (Almoravids) ও আলমোহাদ (Almohads) রাজ্যের সঙ্গে। কিন্তু ব্রয়োদশ শতাব্দীতে এ রাজ্যই ভাগাভাগি হয়েছিল তিনটি বিভিন্ন বংশের মধ্যে। সুদূর পশ্চিমে ছিল মারি নিডস (marinids) অথবা মরক্কো; মধ্য পশ্চিমে ছিল জিয়া নিডস (Ziyanids) যার রাজধানী ছিল লেমসেন (Tlemsen); তিউনিস পড়েছিল হাফসিডসদের (Hafids) অংশে যার ইফরিকিয়া (Ifnqiya) প্রদেশ বিস্তৃত ছিল আলজিয়ার্স থেকে ত্রিপলী পর্যন্ত।
এভাবে সাম্রাজ্য বিভক্ত হবার ফলে যে বিপদ দেখা দিয়েছিল তা আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষের দরুন। একদিকে ছিল রাজ্যের চাষোপযোগী ভূমিখণ্ডের উপর যাযাবর আরব ও বারবারদের উৎপাত, অন্যদিকে নৌশক্তির অধিকারী খ্রীস্টান রাষ্ট্রগুলির ক্রমবর্ধমান আক্রমণ ভীতি । রাজ্যের শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে নিষ্ফল হানাহানির ফলে বিপদের মোকাবিলা করার উপযোগী শক্তিসামর্থ্য তারা হারিয়ে ফেলেন। উপরি-উক্ত তিনটি রাজবংশের ভিতর সর্বাপেক্ষা উন্নত ছিল তিউনিসের হাফসিডগণ। এমন কি তাদের কর্তৃত্ত্বেও অনবরত এসে বাধার সৃষ্টি করত রাজ্যের সীমান্তবর্তী প্রদেশ সমূহের শাসনকর্তাগণ। যদিও তারা ১২৭০ খ্রীস্টাব্দে সেন্ট লুইর ক্রুসেড প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছিলেন তথাপি অনধিক বিশ বছরের মধ্যেই তারা সিসিলিয়ানদের কবলে জেবরা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পরে ১৩৩৪ খ্রীস্টাব্দে জেবরা পুনরুদ্বারে সমর্থ হন নিয়াপলিটান ও জেনোইসদের সহায়তায়। প্রকৃতপক্ষে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল কেবল সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় এবং অভ্যন্তর ভাগে ছিল মাত্র কয়েকটি সুরক্ষিত শহর। তিউনিসের সমৃদ্ধির মূলে ছিল তার সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান। অভ্যন্তর ভাগ থেকে প্রসারিত প্রধান বাণিজ্যপথগুলির মুখে ছিল তিউনিসের অবস্থান এবং তার ফলেই তিউনিস হয়েছিল মাগরিবের প্রধান বাণিজ্য শহর। ভূমধ্য সাগরাঞ্চলের মুসলিম বন্দরগুলির মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ার পরেই ছিল তিউনিসের স্থান। মাগরিবের অন্যান্য অংশের ন্যায়। তিউনিসের কৃষ্টি ও তমদুন রক্ষিত হয়েছিল স্পেন হতে বিতাড়িত মুসলিম মোহাজেরদের দ্বারা।