সর্বপ্রথম ইবনে বতুতার নাম সর্বসমক্ষে প্রচারিত হয় ১৮২৯ খ্রীস্টাব্দে ডা. স্যামুয়েল লি কর্তৃক অনূদিত একখানা সংক্ষিপ্ত পুস্তকের দ্বারা। তার ভ্রমণের পুর্ণাঙ্গ বিবরণীটি কয়েক বছর পরে আলজিরিয়ায় পাওয়া যায়। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের বহু সংখ্যক পাণ্ডুলিপি থেকে ডিফ্ৰিমারী ও সাইনেটির ব্যাখ্যাসহ উক্ত ভ্রমণ বিবরণীর একটি ফরাসী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। পাণ্ডুলিপিগুলির একখানাতে ইবনে বতুতার বিবরণীর দ্বিতীয় অর্ধাংশ পাওয়া যায়। সে অংশটি ছিল মূল সফরনামা সম্পাদক ইবনে জুজায়ীর স্বহস্তলিখিত। ফরাসী অনুবাদটিকে মোটের উপর আরবী গ্রন্থের সঠিক অনুবাদ বলে গ্রহণ করা গেলেও তাতে ব্যাখ্যা সম্বলিত টীকার অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফরাসী ভাষায় অনূদিত সফরনামার বিভিন্ন অংশে উল্লেখিত দেশগুলির বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পণ্ডিতগণ এতে অনেক টীকাটিপ্পনী যোগ করেছেন, কিন্তু তা’হলেও বহুলাংশের টীকা এখনও বাকি রয়েছে। বর্তমান সংকলন গ্রন্থটি অনুদিত হয়েছে সরাসরি আরবী হতে। এ-গ্রন্থে ইবনে বতুতাকে ভূগোল রচয়িতা রূপে না দেখিয়ে পরিব্রাজকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, এ-গ্রন্থে এবং টীকাটিপ্পনীতে এমন যথেষ্ট ইংগিত দেওয়া হয়েছে যার সাহায্যে যে কোন একটি বৃহদাকার মানচিত্রের মাধ্যমে ইবনে বতুতার ভ্রমণপথ সহজে অনুধাবন করা যাবে। অবশ্য এ বিবরণীর নানা ভৌগোলিক সমস্যা সম্বন্ধে নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে।
বর্তমান অনুবাদে এলিজাবেথের আমলের মার্জিত ভাষা বাদ দিয়ে ইবনে বতুতার মূল গ্রন্থের সহজ ভাষাই যতদূর সম্ভব রক্ষা করা হয়েছে। তাঁর মূল গ্রন্থের বর্ণনা ও কাহিনীর অফুরন্ত সম্পদ থেকে সংকলন করা সহজসাধ্য কাজ নয়। কাজেই বহু বিচিত্র অধ্যায়কে বাদ দিতে হয়েছে অথবা সংক্ষেপ করতে হয়েছে। তথাপি আশা করা যায়, যতদিন মূল গ্রন্থটির পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ (যা হাফলুইট সোসাইটির জন্য লেখক বর্তমানে তৈরী করেছেন।) প্রকাশিত না হয় ততদিন এ সংকলন গ্রন্থটিই ব্যাপকভাবে ইংরেজী। ভাষার পাঠকদের কাছে ইবনে বতুতার যুগের অথবা যে কোন যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিব্রাজককে পরিচিত করতে সহায়ক হবে।
.
ঐতিহাসিক পটভূমি
চতুর্দশ শতাব্দীর মুসলিম জাহান তার বিস্তৃত ও বাহ্যিক জাক জমকের দিক দিয়ে অষ্টম শতাব্দীর দামেশক ও বাগদাদের খলীফা শাসিত বিশাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তুলনায় বিশেষ নগণ্য ছিল না। পশ্চিম দিকে স্পেন ও সিসিল থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তার সঙ্কুচিত হলেও ভারত ও মালয়েশিয়ার দিকের বিস্তৃতির দ্বারা সে ক্ষতির পূরণই শুধু হয়নি, অতিরিক্ত বিস্তৃতিও ছিল। ধর্মযুদ্ধেরত ফ্রাঙ্কদের হস্তে পরাজয়ের গ্লানির শেষ চিহ্ন মুসলিম জাহান সম্প্রতি অপনোদনে সক্ষম হয়েছিল। এবং ইউরোপে তুরস্কের তরবারি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশোধ গ্রহণেও উদ্যত হয়েছিল। তথাপি একথাও সত্য যে, আপাতঃ দৃষ্টিতে এ সকল উন্নতির চিহ্ন বর্তমান থাকা সত্ত্বেও ইসলামের রাজনৈতিক কাঠামো মারাত্মক ভাবে ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। কালের প্রভাবে ইসলামের বিরাট সৌধে জীবনীশক্তির অতীব অপচয় ঘটেছিল এবং তখনও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েও তার মূলে আঘাত লেগেছিল।
সিরিয়ার উপকূল থেকে সর্বশেষ জেহাদীদের অবশ্যই বিতাড়িত করা হয়েছিল, কিন্তু সে বিতাড়নের জন্য কি উচ্চমূল্যই না দিতে হয়েছিল । জেহাদের প্রারম্ভে পূর্বপুরুষের যোদ্ধাগণ যাকে সীমান্তের সামান্য সংঘর্ষ বলে মনে করেছিল তাই প্রতিহত করতে পূর্ণ দুই শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রয়োজন হয়েছিল। নমনীয় আরব ও কৃষ্টির অধিকারী পারসিকদের হস্ত থেকে রাজশক্তি চলে গিয়েছিল কঠোর ও অনুদার তুর্কীদের হস্তে। খ্রীষ্টীয় ১০০০ শতাব্দীর পর প্রায় দুইশত বছর ধরে ক্ষমতালোভী তুর্কী সৈন্যাধ্যক্ষদের আক্রমণে মুসলিম জাহান ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। তাদের আক্রমণ ও কুশাসনের ফলে দেশের যে পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছিল তা কোন বিদেশী শত্রুর দ্বারাও সম্ভব হয়নি। আলোড়নের পর আলোড়ন চলতে থাকে, অতঃপর মধ্য এশিয়ার বর্বর মঙ্গোলগণ এসে তুর্কী সিংহকে পরিণত করে মেষশাবকে। তারা ১২৫৮ খ্রীস্টাব্দে ইসলামের পরিত্যক্ত ভুখণ্ডকে তাদের বিরাট সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করে।
এ ঘটনা মুসলমানদের কাছে রোজকেয়ামতের খোদাই গজবের মত প্রথমে মনে হলেও পরবর্তী কালে এ ঘটনার অভিশাপই আর্শীবাদে পরিণত হয়েছিল। পুনরায় পূর্বাঞ্চলের মুসলিম প্রদেশগুলি সুদৃঢ় শাসনাধীনে থেকে নিরাপত্তা উপভোগ করতে লাগল। ফলে কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতির যে আশা চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়েছিল তাও পুনরায় আশাপ্রদ হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে মিসর ও সিরিয়া মঙ্গোল আক্রমণের মুখে যারা অস্তিত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছিল পর পর কয়েকজন ক্ষমতাসম্পন্ন ও উপযুক্ত শাসকের অধীনে শান্তিতে ও নিরাপদে থেকে ক্রমশঃ বিশেষ উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। তুর্কী সিপাহীসালারগণ একদিন শুধু মধ্য প্রদেশগুলির ছিন্নবিচ্ছিন্ন টুকরাসমূহ নিয়ে হানাহানি করেছিলেন। এবার তারা বিতাড়িত হলেন সীমান্তের দিকে। অতঃপর তারা বিধর্মী ও কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করে সমরলিন্স মিটাতে লাগলেন। এ উপায়ে পার্থিব সম্পদের কিছুটা অংশ অধিকার করতে সমর্থ হয়েছিলেন ও জেহাদী’র খ্যাতি অর্জন করে নিজেদের জন্য পরলোকে সম্মানজনক আসন। শাস্ত্রে ব্যবস্থা করেছিলেন। মঙ্গোল বিজয় এভাবে ভারতের ও তার কয়েক বছর পরে প্রেস ও বলকান উপদ্বীপে ইসলামের বাহু সম্প্রসারণে সহায়তা করে। এ সফলতা পুষ্ট হয়েছিল ইসলাম প্রচারক ও দরবেশদের কর্মতত্রপতার দ্বারা।