গ্রন্থখানা সমগ্রভাবে বিচার করে দেখলে আমরা অবশ্যই স্বীকার করব যে, চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয় চতুর্থাংশের মুসলিম সমাজ সম্বন্ধে একটি বিস্তৃত বিবরণ দানই ছিল এ গ্রন্থ রচনার মূল উদ্দেশ্য। আমরা একাধিকবার লক্ষ্য করেছি যে, কোন বিশেষ স্থানের চেয়ে ব্যক্তিবিশেষের প্রতিই ইবনে বতুতার আকর্ষণ ছিল সমধিক। তাঁর বিবেচনায় ভূগোলের চেয়ে সব সময়েই মানুষ ছিল বড়। তাঁর ভৌগোলিক জ্ঞান বলতে ছিল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও দৈবক্রমে পরিচিত লোকদের কাছে সংগৃহীত সংবাদ। কোন বিষয়ের বিস্তৃত বিবরণ দিতে হলেই তিনি নির্ভর করতেন স্মৃতিশক্তির উপর। ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার প্রচলিত সাধারণ পদ্ধতির মাধ্যমে তাঁর স্মৃতিশক্তিও বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করেছিল। বেশ কিছুসংখ্যক পুস্তক কণ্ঠস্থ করণই ছিল শিক্ষার পদ্ধতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইবনে বতুতার বর্ণনায় ভুলভ্রান্তির অবকাশও ছিল যথেষ্ট। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনের ধারাবাহিক বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি পরের বিবরণ পূর্বে এবং পূর্বের বিবরণ পরে দিয়েছেন। দু’বার এমনও হয়েছে যে তিনি যেন নিজেকে হাওয়ার মধ্যে ছেড়ে দিয়েছেন- শত শত মাইল পরিভ্রমণের কোন বিবরণই তিনি দেননি। কোন-কোন স্থানে তিনি ভুল নাম উল্লেখ করেছেন, বিশেষ করে ভুল করেছেন অমুসলমান দেশের বিবরণ দিতে গিয়ে। কারণ, ঐ সব স্থানে তার আরবী ও ফারসী ভাষার জ্ঞান বিশেষ কার্যকরী হয়নি। তার ঐতিহাসিক বিবরণী সাধারণতঃ যাকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়, নির্ভুল নয়। অবশ্য তাঁর গ্রন্থে উল্লিখিত অসংখ্য ব্যক্তি ও স্থানের বিষয় বিবেচনা করলে ভুলত্রুটির সংখ্যা যে অতি নগণ্য তা অনস্বীকার্য। তারিখ সহ তার ভ্রমণ বিবরণী যে পর্যায়ক্রমে দেওয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে বুঝতে পারা এক প্রকার অসম্ভব বলেই চলে। অনেকগুলি তারিখ দেখে মনে হয় সম্ভবতঃ সম্পাদকের অনুরোধে সেগুলি যেখানে-সেখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে সব তারিখ পরীক্ষা ও সংশোধন করা এতই কষ্টসাধ্য যে, এ-গ্রন্থ প্রণয়নে সে চেষ্টাই করা হয়নি।
সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে ইবনে বতুতার বিবরণীর সত্যতা। এ-বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই যে, তার অতিশয়োক্তি ও ভুল বুঝার অংশ ছেড়ে দিয়ে মুসলিম দেশগুলি সম্বন্ধে। তিনি যা সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন অকপটে তারই বর্ণনা দিয়ে গেছেন। কিছু সংখ্যক সমালোচক অবশ্য ইবনে বতুতার কনস্টান্টিনোপল ও চীন ভ্রমণের দাবী সন্দেহের চোখে দেখেন। কনস্টান্টিনোপল দর্শনের বিষয়ে প্রধান অসুবিধা হল ভ্রমণ পথের বিবরণের। অস্পষ্টতা এবং প্রাক্তন সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের উল্লেখ। কারণ ইবনে বতুতার নিজের দিনপঞ্জী অনুযায়ী দেখা যায় প্রাক্তন সম্রাট এক বছর আগেই পরলোক গমন করেছেন। পথের বিবরণের অস্পষ্টতার কারণ হয়তো অপরিচিত পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে আরবী ভাষাভাষী পরিব্রাজকের বুঝতে অসুবিধা বা অক্ষমতা এবং দ্বিতীয় অসঙ্গতির কারণ। সম্ভবতঃ তারিখের ভুল। শহরের বিবরণ কিন্তু এত বিশদ ও নির্ভুল যে, তা ইবনে। বতুতার মত সর্বপ্রকার সুবিধা সহায়তা লাভের অধিকারী প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির হতেই পারে না। এমন কি, প্রাক্তন সম্রাটের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের। বিবরণের মধ্যেও সত্যের নির্ভুল ছাপ রয়েছে।
চীন যাত্রার পথের ও চীনের অভ্যন্তরে বিবরণীর ব্যাপারে একই ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তার পূর্ণ বিবরণ যথাস্থানে দেওয়া হবে। এখানে এটুকু বললেই যথেষ্ট যে, ইবনে বতুতার চীনে যাওয়া ও চীন ভ্রমণের বিবরণ অস্বীকার করতে গেলে। অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় এবং একই রকম যুক্তি দ্বারা সহজে প্রমাণ করা সম্ভব হয়। যে, তিনি ভারতেও যান নাই, যদিও ভারতে তিনি অবশ্যই গিয়েছিলেন। ইবনে বতুতা। যখনই পরের নিকট হতে সংগৃহীত তথ্যের উপর নির্ভর করেছেন তখনই দেখা যায় তার বিবরণী সন্তোষজনক হয়নি। অথচ অন্যের দেওয়া তথ্যের কিছুটা না নিয়ে শুধু নিজের দেখা বিষয়ের উপর নির্ভর করে এত বড় গ্রন্থ রচনা করা প্রায় অসম্ভব। তার চীন ভ্রমণের স্বপক্ষে কতকগুলি জোরালো যুক্তিও রয়েছে। দিল্লীর সুলতানের দূত হিসেবে তার চীন গমণের যথেষ্ট কারণ আছে এবং চীনের অভ্যন্তরভাগে ভ্রমণের তার যে। সুযোগ-সুবিধা ছিল তা অন্য কোন সাধারণ সওদাগরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত: খানসা (হ্যাং চাও) অবস্থানকালীন কার্যকলাপের বিবরণের এক স্থানের অস্পষ্টতা আসামে শেখ জালাল উদ্দীন সন্দর্শনে গমনের বিষয়ে প্রদত্ত পূর্ববর্তী এক বিবরণীর দ্বারা। দূরীভূত হয়। তাঁর চীন ভ্রমণের সঙ্গে আসাম ভ্রমণের সম্পর্ক খুব নিবিড়। তৃতীয়ত: তার চীন ভ্রমণের দাবী যদি মিথ্যা হয় তবে তার ধরা পড়বার সম্ভাবনাও যথেষ্ট ছিল। উত্তর চীনে ভ্রমণ কালে তিনি যে সিউটা হতে আগত একজন সওদাগরের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন সে কথা জোর দিয়ে বলেছেন। উক্ত সওদাগর ছিলেন মরক্কোর অন্তর্গত সিজিল মাসার জনৈক অধিবাসীর ভ্রাতা। তার সঙ্গে পরবর্তীকালেও ইবনে বতুতার পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটেছিল। সেকালেও মরক্কোর সঙ্গে উক্ত বণিকের যোগাযোগ ছিল তা অসম্ভব নয়। কারণ এক সময়ে ইবনে বতুতা নিজেও ভারত থেকে কিছু টাকা মেকুইনেজে পাঠিয়েছিলেন। অতএব ইবনে বতুতার চীন ভ্রমণ আমার কাছে মোটের উপর প্রকৃত বলেই মনে হয়, যদিও এ বিবরণ সংক্ষেপ করা হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। সম্ভবতঃ এর কারণ ছিল চীনের নামগুলি ইবনে বতুতা শিখে থাকলেও আরবী ফারসী নামের মত তা সঠিকভাবে স্মরণ রাখতে সক্ষম হননি কিংবা গ্রন্থ সম্পাদকই এ বিবরণটি সরাসরিভাবে সংক্ষেপ করেছেন। বস্তুতঃ আমাকে ইবনে বতুতার চীন সফরের বিবরণী বিশ্বাস করতে হয়, নতুবা ধরে নিতে হয় যে, ভারতে তিনি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন যে দরবেশের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তারই সম্মোহন শক্তির প্রভাবে তিনি চীন সফর করেছেন বলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন।