আলেকজান্দ্রিয়া থেকে রাব্বারি উপকূল অবধি সফর নিরাপদ ছিল না। দু’বার তিনি খ্রীস্টান সৈন্যদের কবলে পড়তে পড়তে কোনক্রমে রক্ষা পান এবং প্রায় ফেজের কাছাকাছি গিয়ে তার কাফেলা একদল দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু তবু তার আকাভক্ষার নিবৃত্তি হয়নি। তখনও দুইটি মুসলিম রাষ্ট্র-আন্দালুসিয়া ও নাইজার নদীর তীরস্থ নিগ্রো দেশ তার সফর করা হয়নি। কাজেই পুনরায় তিনি তার ভ্রমণের যষ্টি হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন এবং তিন বছরকালের মধ্যে যে পর্যন্ত না ন্যায়ত ‘ইসলামের সফরকারী’ আখ্যায় আখ্যায়িত হলেন সে পর্যন্ত যষ্টি হাত থেকে নামালেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন মধ্যযুগের একমাত্র সফরকারী যিনি তৎকালীন মুসলিম শাসিত সব দেশ তো সফর করেছেনই, অধিকন্তু সফর করেছেন বিধর্মীদের দেশ কনস্টান্টিনোপল, সিংহল ও চীন। মিঃ ইউল নির্ণয় করেছেন, ইবনে বতুতা কমপক্ষে ৭৫ হাজার মাইল পরিভ্রমণ করেছেন। বাষ্পীয় যান আবিস্কারের আগে কারও পক্ষেই এত দীর্ঘপথ পরিভ্রমন সম্ভব হয়নি।
দুঃখের বিষয়, সেকালে সফরকালে যারা তাঁকে দেখেছেন এমন কারও বিবরণ, যতদূর জানা যায়, আজ পর্যন্ত আমরা পাইনি। তাঁর সমসাময়িক লেখকদের লেখায় মাত্র দু’টি স্থানে তার বিষয়ে উল্লেখ দেখা যায়। সে উল্লেখও আবার তার বক্তব্যের সত্যতা সম্বন্ধে বিতর্কতামূলক। ব্যক্তিগতভাবে ইবনে বতুতার প্রতি তাদের ধারণা কিরূপ ছিল তা আমরা জানতে পারি না; কিন্তু তাঁর নিজের অকপট বিবৃতি থেকে আমরা তার সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নিতে পারি। আমরা দু’বার একবার দিল্লীতে এবং আরেকবার মালদ্বীপে, বিপুল সম্বর্ধনা পেয়েও– ইবনে বতুতাকে বিরাগ ও সন্দেহভাজন হতে দেখি। তার প্রথম কারণ ছিল তাঁর অসামান্য অপব্যয়িতা এবং দ্বিতীয় কারণ ছিল তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং স্বাধীনচেতা মতবাদ। এ-বিষয়ে কোন সন্দেহই। নেই যে, ইবনে বতুতা চাইতেন, রাজ-রাজড়া ও উজির হবেন অতিমাত্রায় দানশীল ও বদান্য। তাদের পক্ষে দিল-দরাজী ও দস্তদরাজীই হবে লোকের চোখে তাঁদের সম্মান লাভের যোগ্যতার মাপকাঠি। ইবনে বতুতা কোন সুলতান সম্বন্ধে যখন বলেছেন, তিনি ভাল সুলতান বা ভাল শাসনকর্তাদের একজন, তখনই বুঝে নিতে হবে, সে সুলতান ধর্মীয় বিধানসমূহ যথাযথ পালন করেন এবং বিশেষ করে ধর্মতত্ত্বজ্ঞ লোকদের প্রতি। তিনি মুক্তহস্ত। আমরা সহজেই বুঝতে পারি তাঁর এ মনোভাব তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের বিরক্তির উদ্রেক করেছিল, ফলে অপ্রীতিকর ঘটনা অথবা পরস্পরের প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করেছিল। এ ধরনের দু’একটি ঘটনা বাদ দিয়ে ইবনে বতুতা যেখানেই পদার্পণ করেছেন সেখানেই পেয়েছেন বিপুল সমাদর ও সম্মান।
ইবনে বতুতার সফরনামার প্রকৃত মূল্য নিরূপণ করতে গেলে অবশ্যই তাঁর গ্রন্থটির মোটামুটি বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন। যে-সব জায়গা তিনি পরিভ্রমণ করেছেন সে-সব জায়গার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হয়তো তিনি লিখে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, তেমন কিছুই তিনি করেননি। সুদীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনীর মাত্র একটি স্থানে তার কিছু লিপিবদ্ধ করে রাখার উল্লেখ দেখা যায়। তিনি বলেছেন, বোখারা সফরকালে সেখানকার জ্ঞানী ব্যক্তিদের কবরের উপরস্থ প্রস্তর ফলকের লেখাগুলি তিনি নকল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে যখন ভারতীয় জলদস্যুরা তার যথাসর্বস্ব লুণ্ঠন করে তখন সেগুলিও হারিয়ে যায়। কবরের প্রস্তর ফলকে উত্তীর্ণ লেখাগুলি পণ্ডিত ও ধর্মপ্রাণ। লোকদের কাছে আকর্ষণের বন্ধু ছিল, কারণ, ঐগুলি ছিল পরলোকগত লোকদের লেখার তালিকা। ইবনে বতুতা নিজে লেখক ছিলেন না এবং তার অভিজ্ঞতার বিবরণী যে একটি গ্রন্থের বিষয়বস্তু হতে পারে তাও তিনি ধারণা করেননি। মনে হয় তিনি সেগুলি লিপিবদ্ধ করার কথাও চিন্তা করেননি।
ফেজ শহরে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি তাঁর অভিযানের বিষয় সুলতানের ও তার দরবারের লোকদের নিকট বর্ণনা করেন। ইবনে বতুতার সমসাময়িক বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খলদুনের গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই, তাঁর বর্ণিত কাহিনীর অধিকাংশই অবিশ্বাস্য বলে গণ্য হয়েছিল। কিন্তু দরবারের ক্ষমতাশালী উজিরের সমর্থন তিনি পেয়েছিলেন এবং উজিরের পরামর্শ মতই সুলতান তার অন্যতম প্রধান কর্মাধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইবনে জুজায়ীকে সেগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখতে আদেশ দেন। তখন ইবনে বতুতার বর্ণনানুযায়ী ইবনে জুজায়ী এ-গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তার ফলে বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ এ-গ্রন্থখানা আমরা পেয়েছি। লেখক কিন্তু সর্বদা ইবনে বতুতার বর্ণিত বিষয় অবিকল লিপিবদ্ধ করে সন্তুষ্ট হননি। প্রতিটি বিদেশী নামের সঠিক উচ্চারণ তিনি বিশেষ যত্নে লিখে নিতেন। আরবী হরফের বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য করলে বিদেশী এই নামগুলির সঠিক উচ্চারণ লিপিবদ্ধ করা একটি গুরত্বপূর্ণ কাজ বলেই গণ্য হবে। কিন্তু অন্যান্য কয়েকটি ব্যাপারে ইবনে জুজায়ীর গ্রন্থ সম্পাদন পদ্ধতি সমালোচনার উর্ধ্বে নহে। তার নিজ উক্তি হতেই জানা যায় যে, গ্রন্থটি সংক্ষেপ করা হয়েছে। সম্ভবতঃ গ্রহের শেষ পর্যায়ে দু’একটি অংশ সংক্ষিপ্ত হবার এই কারণ। কোন-কোন স্থানে সামান্য পরিবর্তন ছাড়া ভ্রমণ বৃত্তান্তের অধিকাংশই বিবৃতি-দানকারীর কথা সরল ও সহজ। ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। যুগোপযোগী ও রুচিসম্মত করার উদ্দেশ্যে ইবনে জুজায়ী মার্জিত ভাষা ব্যবহার ও কবিতাংশ উদ্ধৃত করে বিবৃতিটিকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে সফলকাম হননি। স্বীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা দান কালে ইবনে বতুতা যদি অন্য কোন বিষয়ের অবতারণা করে থাকেন তবে তা বরং ক্ষমার যোগ্য, কিন্তু অনন্যর বেলায় অনুরূপ কার্য সমর্থনযোগ্য নয়। প্রমণ বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করার সময় তার সম্মুখে ছিল দ্বাদশ শতাব্দীতে মিসর, হিজাজ ও সিরিয়া ভ্রমণকারী আন্দালুসিয়ার পণ্ডিত ইবনে জুবাইয়ের ভ্রমণ বিবরণী। পাশ্চাত্য জগতে সে গ্রন্থখানা বিশেষ সমাদর লাভ করেছিল। যে-সব স্থান ইবনে বতুতা ও ইবনে জুবাইর উভয়েই ভ্রমণ করেছেন সে-সব স্থানের বিবরণ করতে গিয়ে ইবনে জুজায়ী ইবনে জুবাইয়ের ভ্রমণ বিবরণী থেকে অকৃপণভাবে সংক্ষিপ্তাকারে নকল করেছেন। বিশেষ করে হজের সময় এবং বছরের অন্যান্য সময় যেসব অনুষ্ঠান পালন করা হয় তার বিবরণসমূহ ইবনে জুবাইয়ের গ্রন্থ হতে নেওয়া হয়েছে। সম্ভবতঃ ইবনে বতুতার অনুমোদন ক্রমেই এ-কাজ করা হয়েছে। কাজেই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইবনে বতুতার গ্রন্থের সম্পূর্ণটা তাঁর নিজের বর্ণনা নয়। বিশেষ করে পারস্য ভাষা থেকে অনূদিত বাক্যাংশ দেখে মনে হয় আমাদের সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থকার তাঁর গ্রন্থখানা পাঠ করে দেখেননি অথবা পাঠ করে থাকলেও যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেননি।