ইবনে বতুতা তাঁর সমস্ত ধন-সম্পদ ও চাকরি বর্জন করে শেষ অবলম্বন স্বরূপ বেছে নিলেন দরবেশের জীবন যাপন। পার্থিব জগতের প্রতি তার এ নির্লিপ্ততা ছিল অকৃত্রিম। মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্ব-জ্ঞানিগণ জগতের প্রতি এ নির্লিপ্ততাকে বিশেষভাবেই পছন্দ করতেন। ঘটনাদৃষ্টে মনে হয়, সুলতান মুহম্মদ ইবনে বতুতাঁর অকৃত্রিম সততা ও ধর্মনীতির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কেন না কিছুদিন পরেই যখন রাষ্ট্রদূত হিসাবে চীনে প্রেরণের জন্য একজন বিশ্বস্ত লোকের প্রয়োজন হল, তখন সুলতান ডেকে পাঠালেন ইবনে বতুতাকে। ইবনে বতুতা এক রকম অনিচ্ছার সঙ্গেই দরবেশী খেরকা পরিত্যাগ করে পুনরায় ‘পার্থিব জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন।’ কিন্তু এ-কাজে সম্মত করার জন্য যে উৎকোচ তাঁকে দেওয়া হয়েছিল তার মূল্যও কম ছিল না। প্রায় রাজকীয় জাঁকজমকের সহিত ১৩৪২ খ্রীস্টাব্দে সে আমলের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক মুগল সম্রাটের দরবারে ইবনে বতুতাকে পাঠানো হল।
দিল্লী শহরের প্রাচীরের বাইরে পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় নানা রকম বিপদ আপদ। পলাতক বলে তাকে ধরবার জন্য ক্রমাগত আট দিন অবধি তার পশ্চাদ্ধাবন করা হয়। শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যদিও তিনি তার দলের সঙ্গে মিলিত হতে সমর্থ হন, তখন তার পরিধেয় বস্ত্র ও জায়নামাজ ছাড়া কালিকটের উপকূলে পৌঁছে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। এ অবস্থায় মিশনে যাওয়া সম্ভব পর নয়। এদিকে দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করলেও সুলতানের রোষে পতিত হবার সমূহ সম্ভাবনা। তার পরিবর্তে তিনি মালাবার উপকূলে দেশীয় স্বাধীন রাজদরবারে ভাগ্য পরীক্ষা করতে মনস্থ করলেন এবং মালদ্বীপপুঞ্জ উপস্থিত হয়ে অচিরেই সেখানকার কাজী পদে বহাল হয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য হলেন। প্রায় আঠার মাস কাল আলস্যে সময় কাটানোর পর সংস্কারমূলক কার্যে অতিরিক্ত উৎসাহ দেখাবার ফলে কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি বিরাগ ও সন্দেহভাজন হয়ে ওঠেন। তখন সে দ্বীপ ত্যাগ করে অন্যত্র যাওয়া তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তার অন্তরে যে সর্বত্যাগী তাপসের মূর্তি ছিল সে যেনো আবার জেগে উঠল। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য হলো সিংহলের সর্বোচ্চ পর্বত শিখরে অবস্থিত আদমের কদম মোবারক জেয়ারত করা। সে কাজ সমাধা করে তিনি পুনরায় ফিরে এলেন করমণ্ডল ও মালাবার উপকূলে এবং স্বল্পকালের জন্য মালদ্বীপে পুনরায় গমন করে চীন যাত্রার জন্য একাগ্রভাবে প্রস্তুত হতে থাকেন।
সমুদ্র যাত্রার পথে অনুকূল আবহাওয়া শুরু হতে তখনও কিছু বিলম্ব ছিল। এ সময় তিনি সদ্র পথে বাংলাদেশ সফর করবেন, মনস্থ করলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তার। এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল আসামবাসী একজন প্রসিদ্ধ শেখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। অতঃপর তিনি সুমাত্রা থেকে চীনগামী জাহাজে আরোহণ করেন। এসব জাহাজের মালিক ছিলেন মুসলমান সওদাগরেরা। জাহাজের খালাসীরা ছিল মালয় ও চীনের অধিবাসী। ইবনে। বতুতার সফরনামা ব্যাখ্যাকারীদের মতে তিনি ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর চীনের ‘সাংহাই’ অবধি গমন করেন। সাংহাই বন্দর তখন বিদেশী বণিকদের কাছে শওয়ান চৌ-ফু বা জয়তুন নামে পরিচিত ছিল। এই সফরকালে ইবনে বতুতা রাজদূতের ভূমিকা গ্রহণ করেন। আজ আমাদের কাছে অবশ্যই কিছুটা অদ্ভুত বলে মনে হবে যে দূতাবাস ও পরিচয়বিহীন এ রাজদূতকে কেউ কোন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন নি। চীনের ভেতর দিয়ে তিনি যাতে অবাধে অগ্রসর হতে পারেন সেজন্য রাজদূতের ভূমিকা ছিল তাঁর একটি কৌশল মাত্র। অবশ্য চীনের বাণিজ্য বন্দরগুলিতে তার স্বধর্মী মুসলমানদের কাছে। ধর্মতত্ত্বজ্ঞ হিসাবে তার খ্যাতি এ-কাজে যথেষ্ট সহায়ক ছিল। পিকিং যাতায়াতের পথে প্রতি শহরে তিনি বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেন। কিন্তু পিকিং পৌঁছে সম্রাটের অনুপস্থিতির দরুন তার সাক্ষাতে বঞ্চিত হয়ে তিনি কিছুটা হতাশ হন।
জয়তুনে ফিরে তিনি পুনরায় সুমাত্রার জাহাজে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে যাত্রা করেন মালাবার। এবারে তিনি দিল্লীর মায়াময় শান-শওকতে পুনরায় প্রলুব্ধ হতে যাবেন না বলে স্থির করেন এবং পশ্চিমাভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। ১৩৪৮ খ্রীস্টাব্দে প্রথমবার যখন সিরিয়ায় কালা মড়ক আরম্ভ হয় তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কয়েকটি মাত্র বাক্যে তিনি সে মড়কের ভয়াবহতার একটি পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন। এ সময়ে ভবিষ্যতের জন্য তার কোন পরিকল্পনা স্থির করা ছিল না। তিনি তখন তাঁর। সপ্তম বারের হজ সমাপনের চিন্তাই শুধু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি কারণে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তা বুঝা যায় না। তার প্রত্যাবর্তনের কারণস্বরূপ নিজের। বিবরণে তিনি তদানীন্তন সুলতান আবু হাসান ও তার পুত্র আবু ইনানের অধীনে মরক্কোর দ্রুত উন্নতি ও শক্তিশালী হওয়ার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় তার প্রত্যাবর্তনের কারণ পরিজনের প্রতি আকর্ষণই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। সম্ভবতঃ অতিরঞ্জন ও চাটুকারিতার অংশ বাদ দিয়া তার কথায় আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কিন্তু তানজিয়ারে তাঁর স্বল্পকাল অবস্থিতি এবং যেমন ভাবলেশহীনভাবে তিনি সে বিষয় উল্লেখ করেছেন তাতে তিনি যে গৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য কিছুমাত্র কাতর ছিলেন তা আদৌ ভাবা যায় না। মধ্যযুগের ইসলামের সেই বিশ্বনাগরিক সমাজ বন্ধনের দিনে ইবনে বতুতার গৃহাভিমুখী হওয়ার বিশেষ কারণও ছিল না।