ইবনে বতুতা যখন মিসরে উপনীত হন তার মন আকৃষ্ট ছিল মক্কার পূণ্যভূমির দিকে, এখানে এসেই তিনি সর্বপ্রথম নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পূর্বাভাস পান দু’জন তাপসের নিকট থেকে। এ-সময় থেকেই তার অস্পষ্ট ও ক্ষীণ অভিলাষগুলি স্পষ্টতর রূপ। পরিগ্রহ করে সুনির্দিষ্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়। যদিও সময়-সময় তিনি ইতস্ততঃ করতেন তবু সাধু ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে তার মনের সহজতা খোদাভক্তির উৎস সজাগ হয়ে উঠত। পশ্চিম থেকে হজযাত্রীদের সাধারণ পথ ছিল উত্তর মিসরের মধ্য দিয়ে। সে পথে সরাসরি মক্কা গমণের প্রথম ইচ্ছা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি মত পরিবর্তন। করেন এবং দামেস্কের হজযাত্রী কাফেলার সঙ্গে মক্কা রওয়ানা হতে মনস্থ করেন। দামেস্ক যাবার পথেই সর্বপ্রথম তিনি দেশ ভ্রমণের অনাবিল আনন্দের আস্বাদ গ্রহণ করেন। সময়ের কোন অপ্রতুলতা ছিল না বলে দামেস্কে এসে হজযাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হবার পূর্বেই তিন নিশ্চিত মনে সমগ্র সিরিয়া দেশ পরিভ্রমণ করে এশিয়া মাইনরের সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হন।
মক্কায় প্রথম বার হজ যাপনের সঙ্গে-সঙ্গে তিনি পুনরায় যাত্রা করেন ইরাক পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে; কিন্তু বাগদাদ পৌঁছবার পূর্বেই অন্য পথ ধরে খুজিস্তানের মধ্যে তিনি দীর্ঘপথ পরিভ্রমণ করেন। তিনি বলেছেন, এ সময়ে তিনি যতটা সম্ভব এক জায়গায় একাধিকার গমন করবেন না বলে স্থির করেন। তাঁর মনে তখনও পুনর্বার। হজব্রত পালনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল ছিল এবং তিনি স্থির করেন বছরের শেষে পুনরায় মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পূর্বাকাল পর্যন্ত তিনি দেশভ্রমণেই কাটাবেন। এ-সময়ে তিনি তিন বছর কালের জন্য দেশভ্রমণ স্থগিত রাখেন এবং বিদ্যাচর্চায় ও ধর্মালোচনায় লিপ্ত থেকে মক্কায় বাস করেন। ধর্ম শাস্ত্রজ্ঞদের কাছে হজব্রত পালন যে মুসলমানদের অন্যতম অবশ্য পালনীয় কর্তব্য শুধু তাই নয়, বরং তারা হজের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের প্রাণকেন্দ্রের বহুবিধ কর্মতৎপরতার সঙ্গে নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ লাভ করেন। তখনকার মক্কা ছিল জ্ঞানী ও সুধীজনের সংস্রবে বাস করে জ্ঞানচর্চার একটি আদর্শ। কেন্দ্রস্থল। এ সকলের চিন্তা যে ইবনে বতুতার মনেও ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এছাড়া অন্য উদ্দেশ্যের কথাও আমরা ভাবতে পারি। মক্কায় অবস্থানকাই তিনি ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষের দিকে রওয়ানা হবেন বলে স্থির করেন। তখনকার দিল্লীর সুলতানের অসীম বদান্যতা স্বভাবতঃই বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ লোকদের আকর্ষণ করত। মক্কায় কয়েক বছর অবস্থানের ফলে তার পদমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, সাধারণভাবে যে পদ তিনি পেতে পারেন তার চেয়ে উচ্চপদ লাভ করবেন এই ছিল ইবনে বতুতার মনের আকাঙ্ক্ষা।
মক্কায় কয়েক বছরের অধ্যয়নকাল কাটিয়ে তিনি সঙ্গী-সাথী সহ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলি ভ্রমণ করতে বের হন এবং পূর্বের মতই মক্কায় ফিরে আসেন। অতঃপর পবিত্র মক্কা নগরী পশ্চাতে রেখে তিনি ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন; কিন্তু প্রথমে তিনি যেরূপ অনুমান করেছিলেন তার যাত্রাপথ তার চেয়ে দীর্ঘতর ও বিপদ সঙ্কুল হয়। জেদ্দা পৌঁছে তিনি দেখতে পান সেখানে ভারত গমনের জন্য কোন জাহাজ প্রস্তুত নেই। ফলে কোন এক অদৃশ্য শক্তির তাড়নায়ই উত্তরাভিমুখে চলতে আরম্ভ করেন এবং এখান থেকেই আরম্ভ হয় তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণ। এশিয়া মাইনরের বিভিন্ন শহরের মধ্য দিয়ে ভ্রমণকালে তিনি বিপুল সমাদর লাভ করেন স্থানীয় মুসলমানগণের দ্বারা। অতঃপর কৃষ্ণসাগর পার হয়ে তিনি প্রবেশ করেন মঙ্গল খাঁর রাজ্যে। কনস্টান্টিনোপল দেখবার সুযোগ লাভ করে এবং মধ্যএশিয়া তৃণভূমি অঞ্চল পাড়ি দিয়ে তিনি খোরাসান পৌঁছেন। এ-সময় হতে তার খ্যাতি-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে পরিচিত হন। তাঁর শিষ্য ও অনুগামীদের সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার ধন-সম্পদ ও এ-সময়ে এত বৃদ্ধি পেতে থাকে যে, তিনি এক। জায়গায় বলেছেন : আমার সঙ্গে আমার অশ্বের সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তা উল্লেখ করতে আমি সাহস করতাম না– পাছে সন্দেহপ্রবণ লোকেরা আমার কথা অবিশ্বাস করে।
এভাবে অবশেষে তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথে ভারতে এসে হাজির হন এবং বিশেষ শান-শওকতের সঙ্গে তাকে দিল্লীতে অভ্যর্থনা জানান হয়। দিল্লীতে তিনি বাদশাহের বিশেষ আগ্রহ ও সাহায্য লাভ করেন এবং উচ্চ বেতনে দিল্লীর মালিকাইত কাজীর পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু এতে তার বৈশিষ্ট্যের কিছুই প্রকাশ পায়নি। কারণ, অনেকের ভেতর তিনিও একজন কাজী মাত্র ছিলেন। কাজীর উক্ত পদে ইবনে বতুতা সুদীর্ঘ সাত বৎসর কাল অধিষ্ঠিত ছিলেন। দিল্লী অবস্থান কালে কখনও-কখনও তিনি বাদশাহের সমরাভিযানের সাথী হতেন, কখনও দরবারে নিজ কার্যে বহাল অবস্থায় পারিপার্শ্বিক অবস্থার খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করতেন। পরবর্তীকালে তাঁর সেই অভিজ্ঞতার যে বিচিত্র বর্ণনা দান করেন তা মধ্যযুগীয় যে কোন মুসলিম দরবারের বর্ণনার চেয়ে বহুগুণে গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন স্বয়ং সুলতান বা তার আমীর ওমরাহ্ কি ভাবতে পেরেছিলেন যে ষষ্ঠ শতাব্দী কাল পরে তাদের খ্যাতি-অখ্যাতি নির্ভর করবে পশ্চিম দেশীয় একজন অজ্ঞাতনামা অমিতব্যয়ী কাজীর ক্ষুদ্র স্মারকলিপি ও স্মৃতিকথার উপর? অবশেষে একদিন শাহী দরবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ফাটল ধরল। রাজরোষের অশুভ ফলাফল স্বভাবতঃই হয় দ্রুত এবং মর্মান্তিক।