দিল্লী নগরীতে কাজীর পদে নিযুক্ত হওয়ার কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন: তাঁদের বংশে বহুসংখ্যক কাজী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরে তার বর্ণনার এক জায়গায় স্পেন দেশের রনদাহ নামক নগরে তার এক জ্ঞাতিভ্রাতার কাজী-পদে অধিষ্ঠানের উল্লেখ করেছেন। এসব দেখে তিনি উচ্চবংশীয় মুসলিম ধর্মানুরাগী সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন বললে অত্যুক্তি হবে না। তাছাড়া তিনি সাহিত্য ও ধর্মবিষয়ক বিশেষ শিক্ষায়ও নিশ্চয় শিক্ষিত ছিলেন। একস্থানে তিনি স্বরচিত একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছেন, যদিও অন্যান্য স্থানে তার উদ্ধৃত কবিতাগুলি আরবী ভাষার উৎকৃষ্ট কবিতার নিদর্শন বলে গণ্য হবার যোগ্য নয়। তাঁর গ্রন্থের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় ধর্মপ্রাণ মানুষ ও বিষয়ের প্রতি তাঁর অসামান্য আকর্ষণ আমরা লক্ষ্য করি। এ আকর্ষণ আরও পরিস্ফুট হয় তার ভ্রমণ পথের প্রতি শহরে বন্দরে তিনি যে সব কাজী ও ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ লোকের সঙ্গে দেখা করেছেন শুধু তাদের ফিরিস্তি দেখে (সময় সময় অন্য সব কিছুর বর্ণনা বাদ দিয়েও) এবং বিশেষ করে তার ভ্রমণপথের সর্বত্র প্রসিদ্ধ শেখ ও তাপসদের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ দেখে ও তাঁদের অলৌকিক অবদানের উচ্ছ্বাসপূর্ণ বর্ণনা শুনে।
সুতাং কতিপয় ইউরোপীয় পণ্ডিতের মতানুসরণ করে ইবনে বতুতাকে মুসলিম তাপস ও তত্ত্বজ্ঞানীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া বা মুসলিম ধর্ম শাস্ত্রজ্ঞদের প্রতি ‘নির্বোধের’ মত আকৃষ্ট হওয়া এবং সফরকালে দৃষ্ট শহর ও স্থানের বিশদ বিবরণ দানে অবহেলার দোষে দোষারোপ করার প্রশ্ন একান্ত অপ্রাসঙ্গিক। ধর্ম বিষয়ক এসব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণীতে তাঁর ও তাঁর শ্ৰেণীমণ্ডলীর প্রবল আগ্রহ ছিল। এমন কি আজ আমাদের কাছেও সে সব নিরর্থক বা মূল্যহীন নয়। অধিকন্তু এ সব বিবরণী থেকেই আমরা তার সবচেয়ে প্রাণবন্ত বর্ণনার পরিচয় পাই। কোয়েল (আধুনিক আলীগড়) হতে পলায়ন এবং শরীফ আবু ঘুররার বিবরণ এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত।
এ কথা আমাদের স্মরণ রাখতেই হবে যে, তিনি নিজে একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন এবং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল বলেই তিনি দেশভ্রমণে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং জীবনে তা সমাপনও করেছিলেন। মাত্র একুশ বছর বয়স্ক এক যুবক স্বল্প সম্বলের উপর নির্ভর করে চিত্তে যেদিন তার জন্মভূমি ত্যাগ করে সেদিন তার মনে একমাত্র অদম্য আকাঙ্ক্ষা ছিল মক্কায় হজব্রত পলন করা এবং অন্যান্য তীর্থস্থান দর্শন করা। সাধ্যায়ত্ত হলে সারাজীবনে অন্ততঃ একবার মক্কায় গিয়ে হত পালনের যে পবিত্র কর্তব্য প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর উপর ন্যস্ত রয়েছে তাই হল সর্বযুগে মুসলিমদের দেশ ভ্রমণের স্পৃহার চেয়ে বহুগুণে প্রবল। তার ফলে প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক শ্রেণীর মুসলিমগণ যাতে তীর্থ ভ্রমণের এ পবিত্র কর্তব্য সম্পাদন করতে পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ কালে-কালে গড়ে উঠেছে। হজযাত্রীরা উটের কাফেলা নিয়ে যাত্রা করতেন এবং মঞ্জিলে-মঞ্জিলে যাত্রীর সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেত। যাত্রী তার যাত্রাপথের সর্বত্র এবং বিশ্রাম স্থানে সকল ব্যবস্থা পূর্বাহেই সম্পন্ন দেখতে পেত। যাত্রাপথ বিপদসঙ্কুল দেশের মধ্য দিয়ে হলে উটের কাফেলাগুলিকে সশস্ত্র বাহিনীর পাহারাধীনে জায়গায় পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা ছিল। সমস্ত বৃহৎ কেন্দ্রে এবং মধ্যবর্তী ক্ষুদ্রতর কেন্দ্রগুলিতে বিশ্রামাগার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদির খরচে প্রতিষ্ঠিত মুসাফিরখানা ছিল। সে সব স্থানে তীর্থযাত্রীরা সাদর অভ্যর্থনা এবং বিনাব্যয়ে আহার ও সাময়িক আশ্রয় লাভ করত। এসব মুসাফিরখানার ব্যয় নির্বাহ হত দানশীল ব্যক্তিগণের বংশ-পরম্পরা দান করা সম্পত্তির আয় হতে। সাধারণ হজযাত্রীদের জন্যই যখন এসব সুব্যবস্থা ছিল তখন ধর্মতত্ত্বজ্ঞানী লোকদের জন্য ছিল আরও বিশেষ ব্যবস্থা। প্রত্যেক। শহরে তার মুসলিম ভ্রাতৃগণ তাকে আপনজন বলে সাদরে গ্রহণ করত, তার অভাব অভিযোগ পূরণ করত এবং পরবর্তী মঞ্জিলের লোকদের কাছে তার জন্য সুপারিশ করে পাঠাতে। এরূপ অনুকূল পরিস্থিতিতে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের–যার ভেতর বংশগত বা শ্ৰেণীগত কোন প্রভেদ নেই, পরাকাষ্ঠা সাধিত হয় এবং দেশ ভ্রমণের স্পৃহা জাগায়–তার তুলনা অন্য কোন যুগে কোন জাতির ইতিহাসে পরিলক্ষিত হয়নি।
একমাত্র হজযাত্রার মাধ্যমে যে দেশভ্রমণের পথ সুগম হত তা নয়। মধ্যযুগের প্রায় সব সময়েই এশিয়া ও আফ্রিকার বাণিজ্য পথসমূহ এবং ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রায় সবটাই ছিল মুসলিম ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের করতলগত। মুসলিম বণিকদের কর্মতৎপরতা যে কিরূপ ব্যাপক ছিল তা জানবার বহুবিধ উপায়ের মধ্যে ইবনে বতুতার সফরনামাও একটি উপায় মাত্র। অরাজকতার সময় সওদাগরদের পণ্যবাহী উটের কাফেলাগুলি হজযাত্রীদের কাফেলার চেয়ে অধিকতর বিপদের সম্মুখীন হলেও সাধারণ পথিকদের জন্য তাদের কাফেলা ছিল কিছুটা নিরাপদ। আমাদের। বিবরণী হতেই প্রমাণিত হয় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে সব সময়ে যে দয়া-দাক্ষিণ্যের পরিচয় পাওয়া যায় এ সব সওদাগরও তার ব্যতিক্রম ঘটতে দিতেন না। প্রয়োজনের সময় তারা তাদের সহযাত্রীদের সঙ্গে। নিজেদের খাদ্যসম্ভার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ভাগাভাগি করে নিতেন। পরবর্তীকালে ইবনে বতুতা এ-সকল মুসলিম বণিকের বদান্যের কথা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন; কিন্তু যাত্রার শুরুতে নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণাই ছিল না।