এ মসজিদে ইউসূফের কবরও রয়েছে এবং তার কিছু পূর্বে রয়েছে হজরত লূত(৩২) এর কবর। কবরটি সুন্দর একটি অট্টালিকার অভ্যন্তরে। অদূরে আছে লোতের হ্রদ (Dead sea)। এ হ্রদের পানি লবণাক্ত। কথিত আছে সূতের লোকেরা যেখানে বাস করত সেখানেই এ হ্রদটির সৃষ্টি হয়েছে।
হেবরন (ইব্রাহিমের শহর) থেকে জেরুজালেম যাবার পথে বেধূলেহেম-হজরত ঈসার জন্মস্থান। স্থানটি প্রকাণ্ড একটি অট্টালিকায় আবৃত। খ্রীস্টানরা স্থানটিকে তীর্থ হিসাবে গণ্য করে এবং সেখানে যারা গমন করে তাদের অতিথির মত যত্ন করে।
অতঃপর আমরা জেরুজালেমে পৌঁছলাম। খ্যাতির দিক থেকে পবিত্র তীর্থস্থান মক্কা ও মদিনার পরে জেরুজালেমের তৃতীয় স্থান এবং এখান থেকেই আমাদের পয়গম্বর মেরাজ(৩৩) গমন করেন। খ্রীস্টানরা এ নগরটি অধিকার করে সুরক্ষিতভাবে বসবাস আরম্ভ করতে পারে আশঙ্কা করে বিখ্যাত সম্রাট সালাহউদ্দিন ও তার পরবর্তিগণ(৩৪) এর প্রাচীরগুলি নষ্ট করে ফেলেন। জেরুজালেমের পবিত্র মসজিদটি অতি সুদৃশ্য এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মসজিদ বলে খ্যাত। পূর্ব থেকে পশ্চিমে এর দৈর্ঘ্য ৭৫২ রাজ হাত এবং প্রস্থ ৪৩৫ হাত। মসজিদের তিনদিকে অনেকগুলি প্রবেশ পথ আছে। যতদূর দেখেছি, মসজিদটির দক্ষিণদিকে আছে মাত্র একটি দরজা। এ-দরজা দিয়ে শুধু এমাম প্রবেশ করেন। এ মসজিদটি অনাবৃত একটি বৃহৎ চত্বর বিশেষ। কিন্তু আল-আকসা মসজিদটি এর ব্যতিক্রম। আল-আকসা মসজিদের ছাদটি কারুকার্য খচিত এবং সোনালী ও বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত। মসজিদের অংশ বিশেষ ছাদ দ্বারা আবৃত। মসজিদটির গুম্বজ গঠনের শোভা সৌন্দর্য ও দৃঢ়তায় অতুলনীয়। গুম্বজটি মসজিদের মধ্যস্থানে অবস্থিত। মার্বেল পাথরের একটি সিঁড়ি দিয়ে গুঁজে পৌঁছা যায়। গুম্বজের চারটি দরজা, চতুষ্পর্শ এবং অভ্যন্তর মার্বেল পাথরে মণ্ডিত। ভিতরের এবং বাইরের কারুকার্য এবং সাজসজ্জা এত সুন্দর যে ভাষায় তা বর্ণনা করা যায় না। এর অধিকাংশই স্বর্ণাবৃত। কাজেই এর দিকে চাইলেই চোখ ঝলসে যায়, বিদ্যুৎ চমকের মত মনে হয়। গুম্বজের মধ্যস্থলে পবিত্র প্রস্তরখণ্ড। এখান থেকেই আমাদের প্রিয় পয়গম্বর মেরাজে গমন করেন। এ প্রস্তরখণ্ড একটি মানুষের সমান বাইরের দিকে বাড়ানো। তার নিচেই রয়েছে ছোট একটি প্রকোষ্ঠ। সেটিও একটি মানুষের সমান নিচু। নিচে নেমে যাবার সিঁড়িও রয়েছে। প্রস্তরখণ্ড ঘিরে আছে দু’প্রস্থ আবেষ্টনী। যে আবেষ্টনীটি প্রস্তরখন্ড থেকে অপেক্ষাকৃত নিকটে সেটি অতি সুন্দরভাবে লোহা(৩৬) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। অপরটি কাঠের তৈরি।
জেরুজালেমে যে-সব পবিত্র দরগা আছে তার একটি জাহান্নাম (Gehenna) উপত্যকায় শহরের পূর্বপ্রান্তে পাহাড়ের উপর অবস্থিত। কথিত আছে হজরত ঈসা যেখান থেকে বেহেস্তে(৩৭) গমন করেন সেখানে এ-দরগাটি অবস্থিত। এ উপত্যকার নিম্নদেশে খ্রীস্টানদের একটি গীর্জা আছে। খ্রীস্টানরা বলে যে এ গীর্জাটির অভ্যন্তরে বিবি মরিয়মের কবর আছে। একই স্থানে আরও একটি গীর্জা আছে যাকে খ্রীস্টানরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং তীর্থ উদযাপন করতে আসে। খ্রীস্টানদের মিথ্যাভাবে বিশ্বাস করানো হয় যে এ গীর্জার ভেতরে হজরত ঈসার সমাধি আছে। এখানে যারা তীর্থ। করতে আসে তাদের প্রত্যেককে নির্দিষ্ট কর আদায় করতে হয় এবং মুসলিমদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক প্রকার অবমাননা সহ্য করতে হয়। এ স্থানটির নিকটেই আছে। হজরত ঈসার দোলনা।(৩৮) শুভেচ্ছা লাভের জন্য তীর্থযাত্রীরা তা দেখতে আসে।
অতঃপর জেরুজালেম থেকে আমরা গেলাম আসকালনের দূর্গ দেখতে। দুর্গটি তখন পুরোপুরি ধ্বংসের কবলে গিয়ে পড়েছে। ওমরের মসজিদ নামে বিখ্যাত যে মসজিদটি ছিল তারও তখন শুধু দেওয়ালগুলি আছে, আর আছে, মার্বেল প্রস্তরের কয়েকটি স্তম্ভ। কয়েকটি স্তম্ভ তখনও দাঁড়িয়ে আছে, বাকিগুলি ধরাশায়ী। একটি স্তম্ভ চমৎকার লাল রঙের। সেখানকার লোকরা বলে, ক্রীস্টানরা এক সময়ে এ স্তম্ভটি বয়ে নিয়ে যায় তাদের দেশে। কিছুদিন পরে সেটি হারিয়ে যায়। পরে দেখা যায় সেই স্তম্ভটি আসকালনে আবার যথাস্থানে এসে গেছে। সেখান থেকে আমি গেলাম আর-রামলা শহরে। আর-রামলা ফিলিস্তিন (Palestine) নামেও পরিচিত। কথিত আছে এখানকার মসজিদের পশ্চিমদিকে পয়গম্বরদের তিন শ’ জন সমাহিত আছেন। আর-রামলা থেকে। আমি এলাম নাবুলাস (Shechem)। এখানে প্রচুর গাছ-গাছড়া আছে আর আছে। সততঃপ্রবহমান নহর। সিরিয়ার ভেতর জলপাইর জন্য বিখ্যাত স্থানগুলির একটি নাবুলাস। এখান থেকে জলপাই তেল রপ্তানী হয়ে যায় কায়রো ও দামেশক শহরে। নাবুলাসে খরুবা মিষ্টি তৈরি হয় এবং সেসব মিষ্টি এখান থেকে দামেশক ও অন্যান্য। শহরে রপ্তানী হয়। খরুবাগুলিকে প্রথমে জাল দেওয়া হয় তারপর সেগুলিকে পেষণ করে। বের করা হয় রস। সেই রস থেকেই তৈরি হয় মিষ্টি। শুধু রসও দামেশক ও কায়রো। শহরে চালান দেয়া হয়। এছাড়া নাবুলাসে এক রকম তরমুজও পাওয়া যায়। সে তরমুজ খুবই সুস্বাদু।
সেখান থেকে লাধিকিয়ার পথে দ্বায়র হয়ে আজালনে(৩৯) পৌঁছলাম। পথে আকার (Acre) ধ্বংসাবশেষ দেখলাম। আক্কা ছিল সিরিয়ার ফ্রাঙ্কদের রাজধানী বন্দর। তখন কনস্টাটিনোপলের সঙ্গে এ বন্দরের তুলনা চলত।