গ্রন্থটি প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক মরহুম মোহাম্মদ নাসির আলী’-র পরিবারের পক্ষ বাংলা একাডেমী থেকে তুলে জ্যোৎস্না পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী সুহৃদ স্বপন দত্তকে মুদ্রণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে–খুব কম সময়ে এতো বিরাট বিশাল গ্রন্থটি প্রকাশ করে স্বপন দত্ত আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করলেন।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে ‘ইবনে বতুতার সফরনামা’ প্রথম মুদ্রণ পাঠকপ্রিয়তায় শেষ হয়ে যাওয়ায় আমরা পাঠক ও প্রকাশকের কাছে কৃতজ্ঞ।
আজ গ্রন্থটি ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। আমি বলি, কথাটা আত্মঅহমিকা হলেও বলি-বাজারে ২/৪টি ‘ইবনে বতুতার সফরনামা’র ভারতীয় গ্রন্থের পাইরেট মুদ্রণ পাওয়া যাচ্ছে–তবে বাংলা অনুবাদ যা-কিছু তার মধ্যে এটিই সবচাইতে সহজ-সরল উত্তম এবং পূর্ণাঙ্গ-পাঠকবৃন্দ সেটি বুঝতে পারায় আমরা আবারও কৃতজ্ঞতা জানাই।
আশাকরি ভ্রমণ পিপাসু ইতিহাস-প্রিয় ও স্বশিক্ষিত পাঠকবৃন্দের কাছে বইটি ভালো লাগবে।
জর্জ
০১-০১-২০১৪
.
অবতরণিকা
বর্তমান দুনিয়ার কাছে মধ্যযুগীয় খ্রীস্টান সভ্যতার সময়কার মানুষকে মনে হয় অতি দূরবর্তী ও একান্ত অবাস্তব বলে। তাদের নাম ও কার্যকলাপের কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে আমাদের ইতিহাসের পাতায়, তাদের গঠিত স্মৃতিসৌধ আজও আমাদের নগরসমূহ সুশোভিত করছে। তবু তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কসূত্র আজ এত ক্ষীণ যে কিছুটা কল্পনার সাহায্য ব্যতীত তাদেরকে বুঝবার উপায় নেই। সে তুলনায় বিরাট মুসলিম সভ্যতার প্রভাব সম্যক উপলব্ধি করতে হলে কল্পনার সহায়তা যে বহুগুণ বেশি প্রয়োজন তা বলাই বাহুল্য। যদিও সে যুগের মুসলিম সভ্যতা মধ্যযুগীয় ইউরোপের উপর প্রভাব বিস্তার করে তার অস্তিত্বকেই সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছিল এবং শত বন্ধনে জড়িত থেকেও যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভয়-ভীতি অগ্রাহ্য করে শত রকমে তার সঙ্গে গ্রন্থিবদ্ধ ছিল, তবু তা আজ আমাদের কল্পনার বিষয়বস্তু। যে সকল ভাগ্যবান লোক দেশভ্রমণে সক্ষম তারা আজও মুসলিম সভ্যতার স্মৃতিসৌধ সমূহ পরিদর্শন করতে পারেন; কিন্তু সে যুগের মানুষ ও তাদের আচার-ব্যবহার আজ আমাদের কাছে হয়তো সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অথবা মানসপটে ওঠা আরব্যরজনীর রহস্যময় দৃশ্যের মতই তা ক্ষীণ। এমনকি বিশেষজ্ঞদের পক্ষেও সে যুগের মানুষের জীবনযাত্রার প্রকৃত আলেখ্য উদ্ধার করা একটি সুকঠিন কাজ। ইতিহাস ও জীবনচরিত্রের বিশেষত্ব এবং অতীত যুগের নরনারীদের পুনরায় চোখের সামনে রূপায়িত করা সহজসাধ্য নয়। কিন্তু সুদূর অতীতের চরিত্র ও ঘটনাগুলিকে নিবিড় স্পর্শে জীবন্ত করে তোলার ভিতরেই রয়েছে ইবনে বতুতার বৈশিষ্ট্য।
মধ্যযুগের মুসলিম সভ্যতার পটভূমিতে জনমানুষের যে দৃশ্য আমাদের দৃষ্টির সামনে ভেসে ওঠে তার ভেতর ইবনে বতুতার নিজের চরিত্রটিই সবচেয়ে মূর্ত ও জীবন্ত। তার বর্ণনায় তিনি যে আমাদের চোখের সামনে নানা দোষ-গুণে মণ্ডিত নিজের একটি অবিকল প্রতিকৃতি তুলে ধরেছেন তা নয়, বরং মনে হয়, অতীতের পূর্ণাঙ্গ একটি যুগই যেন মৃতের জগৎ থেকে উদ্ধার পেয়ে জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠেছে আমাদের সামনে। ইবনে বতুতার এ সফরনামা ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকগণের দ্বারা অফুরন্তভাবে ব্যবহৃত হয়েছে; কিন্তু তার এ গ্রন্থটি যে প্রধানতঃ মানবচরিত্রের একটি রোজনামচা বিশেষ এবং এতে যে ঘটনাবলীর বিবরণ দান বা তথ্য সগ্রহের স্পৃহার চেয়ে রোজনামচা লেখক ও তার শ্রোতাদের পছন্দ-অপছন্দকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি এ কথাটি যে সমালোচনায় স্থান পায়নি সে সমালোচনা এখছের প্রকৃত মূল্য নিরূপণে আদৌ সক্ষম হয়েছে বলা যায় না। ইবনে বতুতার চরিত্রের যে রূপটি এ গ্রন্থের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে তার প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ-বোধ না করে পারা যায় না। তার চরিত্র ছিল বদান্যতার আতিশয্য। জীবনের মূল্যবোধ যে যুগে ছিল ন্যূনতম সে যুগেও তিনি ছিলেন মনুষ্যোচিত ভাবপূর্ণ দয়ালু নির্ভীক (মধ্যযুগের সফরকারীরা কি সমুদ্রকে কম ভয় করতেন?) আমোদপ্রিয় এবং কিছুটা স্ত্রৈণ। এসব সত্ত্বেও তার চরিত্রে পরিস্ফুট রয়েছে অটল ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মানুরাগ। মানবসুলভ পাপাচারের স্বাভাবিক বাসনা অন্তরে নিহিত থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একান্ত সদাচারী।
ইবনে বতুতার নিজের বর্ণনার বাইরে তার বাহ্যিক জীবন সম্বন্ধে আমরা খুবই কম জানতে পারি। তার সফরনামার সম্পাদক ইবনে জুজায়ী (Juzayy) লিখেছেন : ১৩০৪ খ্রীস্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারী ইবনে বতুতা তানজিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে লিখিত একখানা সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত গ্রন্থে দেখা যায় সফর হতে মরক্কোয় প্রত্যাবর্তনের পরে তিনি মরক্কোর কোন-কোন নগরে কাজী বা বিচারক নিযুক্ত হন। এবং পরলোক গমন করেন ১৩৬৮ খ্রীস্টাব্দে অথবা পরবর্তী বছরে। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মুহম্মদ বিন আবদুল্লাহ। ইবনে বতুতা ছিল তাঁর বংশগত পদবী যা আজও মরক্কোয় প্রচলিত দেখা যায়। তাদের এ বংশ কয়েক পুরুষ পূর্ব থেকেই তানজিয়ারে বসবাস। করছিলেন এবং তারা লুবাতার বারবার সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। এ সম্প্রদায়ের নাম প্রথমে ইতিহাসে স্থান পায় সাইরেনাইকা ও মিসরের সীমান্তবর্তী একটি যাযাবর জাতি হিসাবে।