হেজাজ যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি কায়রো থেকে মিসরের উষ্ণাঞ্চলে যাই। এখানে আমি প্রথম রাত্রি যাপন করি দাইর আত-তিন দরগায়। কয়েকটি প্রসিদ্ধ স্মৃতিচিহ্ন রক্ষণের জন্য এ দরগাটি নির্মিত হয়। হজরত (সাঃ) একটি কাঠের গামলার অংশ, তাঁর সুর্মা ব্যবহারের একটি শলাকা, পাদুকা শেলাইর একটি সূচ বা ফুরনী। এছাড়া আছে হজরত আলীর স্বহস্ত লিখিত একখানা কোরআন। কথিত আছে লক্ষ দিরহাম ব্যয় করে দরগার নির্মাতা এগুলি ক্রয় করেন। এছাড়া আগন্তুকদের খাদ্যদানের জন্য এবং স্মৃতি চিহ্নগুলি রক্ষণাবেক্ষণকারীদের ব্যয় নির্বাহের জন্য কিছু অর্থেরও ব্যবস্থা করে গেছেন।
এখান থেকে আসবার পথে শহর ও গ্রাম পার হয়ে আমি হাজির হলাম মুনিয়াত ইব্নে আসিব (Minie) শহরে। মিসরের উচ্চাঞ্চলে নীলনদের তীরে নির্মিত এটি একটি বড় শহর। এখানে আসবার পথে আমাকে অতিক্রম করতে হয়েছে মানফুলুর, আসিউত, ইয়মিম, কিনা, কুস, লুক্সর, এসৃনা এবং এডনফু। ইথমিমে একটি বারবা(২৫) বা প্রাচীন মিসরীয় মন্দিরে প্রস্তর মূর্তি ও খোদিত লিপি আছে কিন্তু এখন তার পাঠোদ্ধার করা সাধ্যের অতীত। অপর একটি বারবা ভেঙ্গে যাবার পর তার পাথর দিয়ে একটি মাদ্রাসা। তৈরি হয়েছে। কুসে মিসরের উচ্চাঞ্চলের শাসনকর্তা বাস করেন। পুর নামক এই সুন্দর ছোট শহরটিতে ধর্মপ্রাণ তাপস আবুল হাজ্জাজের(২৬) সমাধি বর্তমান। এসৃনা থেকে একদিন ও এক রাত্রি মরু পথে চলে আমরা হাজির হই এডনফু। এখানে নীলনদ পার হয়ে আমরা উট ভাড়া করে একদল আরবের সঙ্গে জনমানবহীন অথচ নিরাপদ মরু পথে রওয়ানা হই। পথে আমাদের একবার বিশ্রাম নিতে হয়েছিল হুমেথিরা নামক স্থানে। এ-স্থানের আশেপাশে অনেক হায়েনার বাস। সারারাত তাই আমাদের হায়না। তাড়িয়ে কাটাতে হয়। তবু একটি হায়না কোন ক্রমে এসে আমার জিনিসপত্রের উপর চড়াও করে একটি বস্তা নিয়ে যায় এবং তার ভেতর থেকে এক থলে খেজুর নিয়ে সরে পড়ে। পরের দিন শূন্য থলেটি আমরা কুড়িয়ে পাই ছিন্ন অবস্থায়।
পনর দিন পর আমরা পৌঁছি ‘আইধার (২৭) শহরে। এখানে প্রচুর দুধ ও মাছ পাওয়া যায়। খেজুর ও শস্যাদি আমদানি হয় মিসর থেকে। এখানকার অধিবাসীদের বলা হয় বেজা। অধিবাসী সবাই কৃষ্ণকায়। এরা হলদে রঙের কম্বলে শরীর আবৃত করে রাখে। এবং মাথায় এক আঙ্গুল পরিমাণ চওড়া ফিতা বেঁধে রাখে। এখানকার মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির কোন অংশ পায় না। আইধারের বাসিন্দাদের প্রধান খাদ্য ছিল উটের দুধ। এ শহরের এক তৃতীয়াংশের মালিক মিসরের সুলতান, বাকি অংশের মালিক বেজাদের আল-হুদরুকি(২৮) নামক রাজা।
আইধারে পৌঁছে আমরা জানতে পারলাম, আল-হুঁদরুবি তখন তুর্কিদের জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছেন এবং তুর্কীরা পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের পক্ষে তখন সমুদ্র পাড়ি দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠল। আমরা অগত্যা আমাদের আয়োজিত সমুদ্র পাড়ির প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রি করে জঙ্গী আরবদের সঙ্গে কুসে ফিরে এলাম। সেখান থেকে পালতোলা নৌকায় নীলনদ দিয়ে আট দিন পরে আমরা কায়রো এসে পৌঁছলাম। সেখানে একরাত্রি কাটিয়েই আমি সিরিয়ার পথে রওয়ানা হই। তখন ১৩২৬ খ্রীস্টাব্দের জুলাইর মাঝামাঝি।
আমাদের পথে ছিল বিলবেস ও আস-সালিহিয়া। সেখান থেকে বালুকাময় পথের শুরু, মধ্যে-মধ্যে সফর বিরতির স্থান। িিতর স্থানে সরাইখানা আছে। এখানকার লোকেরা তাকে খান(২৯) বলে। খানে মুসাফেররা তাদের বাহন পশু নিয়ে বিশ্রাম করে। প্রত্যেক খানেই পানির ব্যবস্থা আছে এবং মুসাফের ও পশুর প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রির জন্য এক একটি দোকান আছে। কাটিয়া(৩০) (Qatya) নামক স্থানের সরাইখানায়। আবগারী শুল্ক আদায় করা হয়। সওদাগরদের কাছ থেকে এবং তাদের মালপত্র তন্ন তন্ন। করে তল্লাসী করা হয়। এখানে অফিস গৃহ আছে, তাতে অফিসার, কেরানী ইত্যাদি আছে। এখানকার প্রাত্যহিক আয় হাজার সোনার দিনার। মিসর থেকে প্রবেশপত্র (পাসপোর্ট) ছাড়া কেউ সিরিয়ায় যেতে পারে না। ঠিক তেমনি সিরিয়ার প্রবেশপত্র না। নিয়ে কেউ মিসরে প্রবেশ করতে পারে না। প্রজাদের মালামাল ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য এবং ইরাকের গুপ্তচর প্রবেশের বাধা দেবার জন্যই এ ব্যবস্থা। এই রাস্তাটি রক্ষার দায়িত্বভার দেওয়া আছে বেদুঈনদের উপর। সন্ধ্যা হলে তারা পথের বালিরাশি এমন করে মসৃণ করে রাখে যাতে কোন পদচিহ্ন দৃষ্ট হয় না, পরের দিন ভোরে শাসনকর্তা এসে বালুকাময় পথ পরীক্ষা করেন। তিনি তখন সে পথে কোন পদচিহ্ন দেখলেই আরবদের হুকুম করেন তাকে ধরে আনতে। তারা তৎক্ষণাৎ সে লোকের পিছু ধাওয়া করে এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে তবে ফিরে আসে। তাকে যথারীতি শাসনকর্তার সামনে হাজির করা হয় এবং তিনি তার শাস্তি বিধান করেন। শাসনকর্তা আমার সঙ্গে মেহমানের মত ব্যবহার করেন, সদয় ব্যবহার করেন এবং আমার সঙ্গে যারা ছিল তাদের সবাইকে যাওয়ার অনুমতি দেন। এখান থেকে আমরা সিরিয়ার প্রথম শহর গাঁজায় পৌঁছি। মিসর সীমান্ত পার হলেই গাঁজা শহর।
গাজা থেকে আমি যাই ইব্রাহিম-এর শহরে (Hebron). এখানকার মসজিদটি বেশ সুন্দর, মজবুত ও উঁচু এবং চতুষ্কোণ প্রস্তরে প্রস্তুত। এ মসজিদের একটি কোণে এমন একটি পাথর রয়েছে যার একটা ধার সাতাশ বিঘত লম্বা। কথিত আছে পয়গম্বর সোলেমান জিনদের(৩১) হুকুম দিয়ে এ মসজিদ তৈরি করান। এ মসজিদের ভেতর ইব্রাহিম, ইছহাক ও ইয়াকুবের পবিত্র কবরও রয়েছে। এ-গুলির উল্টাদিকে তিনটি কবর আছে তাদের বিবিদের। মসজিদের ইমাম একজন বোজর্গ ব্যক্তি। এ কবরগুলি সম্বন্ধে তাকে আমি জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, “যত জ্ঞানীজনের সঙ্গে এ পর্যন্ত আমার দেখা হয়েছে তারা সবাই স্বীকার করেন যে, এ-গুলিই হজরত ইব্রাহিম, ইছহাক এবং ইয়াকুবের ও তাদের বিবিদের কবর। মিথ্যার যারা সমর্থনকারী তারা ছাড়া এ-বিষয়ে আর কেহ কোন প্রশ্ন উত্থাপন করে না। বহুদিন থেকে বংশানুক্রমে সবাই এ বিশ্বাস করে আসছে এবং কেউ এতে কোনদিনও সন্দেহ প্রকাশ করেনি।”