ভামিয়েট্টা থেকে আমি পৌঁছলাম ফারিকোর শহরে। এ-শহরটিও নীলনদের তীরে অবস্থিত। শহরের বাইরে থাকতেই ভামিয়েট্টা থেকে একজন অশ্বারোহী এল আমার। কাছে। তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন ভামিয়েট্টার শাসনকর্তা। অশ্বারোহী আমাকে কিছু অর্থ দিয়ে বলল, “আমাদের শাসনকর্তা আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। আপনি চলে এসেছেন শুনে এই অর্থ আপনাকে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে পুরস্কৃত করুন।”
সেখান থেকে আমি আসমুনে গিয়ে পৌঁছলাম। নীলনদ থেকে বেরিয়ে আসা একটি খালের পারে আসমুন একটি পুরাতন বড় শহর। শহরে একটি কাঠের পুল আছে। অনেক নৌকা এসে এ-পুলের সঙ্গে লঙ্গর থাকে। বিকেলে পুলটি খুলে দেওয়া হয় এবং নৌকাগুলি উজান-ভাটির পথে যাতায়াত করে। এখান থেকে আমি গেলাম সামালুদ। সামালুদ থেকে গেলাম উজানের দিকে কায়রো। একটানা অনেকগুলি শহর ও গ্রামের। মধ্যস্থলে কায়রো। নীলনদ অঞ্চলে সফরকালে পথের সম্বল না নিলেও অসুবিধা হয় না। নীল-নদের তীরে ওজু, গোসল, নামাজ বা আহারের জন্য যেখানে খুশী তা পাওয়া যায়। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো এবং সেখান থেকে মিসরের উষ্ণমণ্ডল অবধি অন্যান্য পথে রয়েছে অসংখ্য বাজারের সারি।
অবশেষে শহুরকুল জননী অত্যাচারী ফেরাউনের বাসস্থান কায়রোতে এসে পৌঁছলাম। কথিত হয় যে,(১৭) কায়রোতে বার হাজার ভিস্তি আছে। তারা উটের সাহায্যে পানি সরবরাহ করে। এছাড়া ত্রিশ হাজার আছে গাধা ও খচ্চর ভাড়া দেবার লোক। নীলনদের বুকে সুলতানের এবং তাঁর প্রজাদের নৌকা আছে ছত্রিশ হাজার। মিসরের উষ্ণাঞ্চল থেকে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া ও ভামিয়েটা অবধি এ-সব নৌকা পাল খাঁটিয়ে যাতায়াত করে বাণিজ্যের নানা বেসাতি নিয়ে।
নীলনদের তীরে পুরাতন কায়রোর অপর দিকে একটি জায়গার নাম বাগিচা।(১৮) অনেকগুলি মনোরম বাগান এখানে আছে। কারণ, কায়রোর লোকেরা আমোদ-প্রমোদের ভক্ত। একবার সুলতানের হাত ভেঙ্গে যায়। তার আরোগ্য উপলক্ষ্য করে সেবার যে আমোদোল্লাস হয় আমি তাতে যোগদান করেছিলাম। শহরের সমস্ত ব্যবসায়ী তাদের দোকানপাট কয়েকদিন অবধি সজ্জিত করে রেখেছিল এবং রেশমী কাপড় ঝুলিয়ে রেখেছিল প্রতিটি দোকানের সম্মুখে। এখানকার মসজিদ আমর-এর প্রতি যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়। শুক্রবারে এখানে নিয়মিত জুমার নামাজ হয়। মসজিদের অভ্যন্তরস্থ পথ পূর্ব থেকে পশ্চিমদিকে প্রসারিত। কায়রোতে মাদ্রাসা রয়েছে অসংখ্য। দুটি দূর্গের মধ্যস্থলে সুলতান কালাউনের সমাধির নিকটে কায়রোর মারিস্তান বা হাসপাতাল। হাসপাতালটির সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। সাজসরঞ্জাম ও ঔষধপত্রও আছে প্রচুর। হাসপাতালের দৈনিক আয় হাজার দিনারের কাছাকাছি।(১৯)
এখানে খানকাহ্ আছে অনেকগুলি। সম্ভ্রান্ত বাসিন্দারা খানকাহু প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এখানে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এক একটি খানকাহ্ ভিন্ন-ভিন্ন সম্প্রদায়ের দরবেশদের জন্য নির্দিষ্ট। দরবেশদের অধিকাংশই শিক্ষিত পার্শিয়ান। তারা মারেফতী বা গুপ্তমতাবলম্বী। প্রত্যেক খানকাহ্র একজন প্রধান ব্যক্তি এবং একজন। দ্বাররক্ষী আছে। তাঁদের কাজকর্ম সুশৃঙ্খলাবদ্ধ। তারা কতকগুলি বিশেষ ধরনের। রীতিনীতি মেনে চলেন। একটি প্রচলিত রীতি আছে আহারের ব্যাপারে। ভোরে বাড়ির খানসামা এসে দরবেশদের কে কি সেদিন আহার করবেন তা জেনে যায়। পরে আহারের জন্য যখন তারা একত্র হন তখন ভিন্ন-ভিন্ন থালায় প্রত্যেকের রুটি ও সুরুয়া। পরিবেশন করা হয়। দৈনিক তাঁরা দু’বার আহার গ্রহণ করেন। তাদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে শীতের ও গরম কালে ব্যবহারোপযোগী কাপড় দেওয়া হয়। তা ছাড়া বিশ হতে ত্রিশ দেরহাম অবধি মাসোহারাও তারা পেয়ে থাকেন। বৃহস্পতিবার রাত্রে তাদের দেওয়া হয় বাতাসা এবং কাপড় ধোবার সাবান। গোসলের উপকরণ এবং বাতির জন্য। তৈল। এঁদের সবাই অকৃতদার। বিবাহিতদের জন্য রয়েছে পৃথক খানকাহ্।
কায়রোতে আছে আ-কারাদার কবরস্তান। এটি একটি পবিত্রস্থান বলে গণ্য। এখানে অসংখ্য জ্ঞানী, গুণী ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির কবর আছে। এখানকার লোকেরা কারাদার কবরগুলি এমনভাবে দেওয়াল দিয়ে ঘেরে যে দেখতে ঠিক অট্টালিকার মতই দেখায়।(২০) তারা কামরাও তৈরি করে এবং কোরআন তেলায়তের জন্য লোক নিযুক্ত করে। সুললিত কণ্ঠে তারা রাদিন সেখানে পবিত্র কোরআন আবৃত করে। অনেকে সমাধি প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও ধর্ম চর্চার স্থান ও মাদ্রাসা স্থাপন করে এবং বৃহস্পতিবার রাত্র সপরিবারে সেখানে অতিবাহিত করে এবং প্রসিদ্ধ কবরগুলি প্রদক্ষিণ করে। শাবান মাসের মধ্যভাগেও তারা একদিন সেখানে নিশা যাপন করে। দোকানদাররা সেদিন সেখানে যায় নানা প্রকার খাদ্যদ্রব্য নিয়ে।(২১)
শহরের পবিত্র স্থানগুলির ভেতর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হল হজরত আল হুসাইনের(২২) সমাধি। সমাধির ধারেই একটি সুদৃঢ় অট্টালিকা। অট্টালিকার দরজার আংটাগুলি রৌপ্য নির্মিত।
সুপেয় পানির জন্য, দীর্ঘতার জন্য এবং প্রয়োজনীয়তার জন্য নীলনদ(২৩) পৃথিবীর অন্যান্য নদীর অগ্রগণ্য। পৃথিবীর অন্য কোন নদীর তীরে এত একটানা শহর ও গ্রাম নেই অথবা এমন শস্য শ্যামল উর্বর ভূমিও নেই। নদীটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত। অন্যান্য প্রসিদ্ধ নদীর গতির পক্ষে এটি একটি ব্যতিক্রম। এ নদের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হ’ল গরমের মৌসুমে যখন অন্যান্য নদনদী প্রায় শুকিয়ে ওঠে তখন এর পানি বৃদ্ধি পায়। নীলনদের পানি যখন কমতে থাকে তখন অন্যান্য নদনদীর পানি বৃদ্ধি পায়। এ-ব্যাপারে নীলনদের মিল আছে একমাত্র সিন্ধু নদের সঙ্গে। পৃথিবীর পাঁচটি প্রসিদ্ধ নদী-নীল, ইউফ্রেটিস, টাইগ্রিস, সির দরিয়া এবং আমু দরিয়া। আরও যে পাঁচটি নদীর সঙ্গে নদীগুলির তুলনা চলে সেগুলি হল- সিন্ধু, যার অপর নাম পাঞ্জাব (পঞ্চ নদী), গ্যাঙ (গঙ্গা) নামক ভারতীয় নদী, যাকে হিন্দুরা তীর্থ বলে মনে করে, মৃতদেহের ভাবশেষ এ নদীতে নিক্ষেপ করে এবং নদীটির উৎপত্তিস্থান স্বর্গ বলে মনে করে, ভারতের যুন (যমুনা অথবা ব্ৰহ্মপুত্ৰ), তৃণাচ্ছাদিত অঞ্চলের ইটিল (ভলগা) নদী যার তীরে রয়েছে সারা শহর এবং কেথের সারু (হোয়াং হো) নদী। এ সব নদীর উল্লেখ আমি যথাস্থানে করব। কায়রো থেকে নিম্নদিকে কিছু দূর গিয়ে নীলনদ ভাগ হয়েছে তিনটি শাখায় (২৪) শীতে বা গ্রীষ্মে এ নদী তিনটি নৌকা ব্যতীত পার হওয়া যায় না। নীলনদ থেকে প্রতি শহরের বাসিন্দারা খাল কেটে নেয় এবং নীলনদের পানি বৃদ্ধি পেলে এ-সব খাল মাঠের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়।