এ শহরের আর একটি বিস্ময়কর বস্তু এর মার্বেল স্তম্ভ। শহরের বাইরে অবস্থিত এ স্তম্ভটি একখণ্ড মার্বেলে সুকৌশলে খোদিত। স্তম্ভটি স্থাপন করা হয়েছে বিরাটকায় প্রস্তরের ইট বেদীর উপর। কি ভাবে কর দ্বারা এ স্তম্ভ বেদীর উপর স্থাপিত হয়েছে কেউ তা বলতে পারে না।(১২)
আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানী লোকদের একজন ছিলেন সেখানকার কাজী। তিনি ছিলেন বাগিতায় সুপটু। বিরাটাকারের একটি শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করতেন তিনি। পাশ্চাত্যের বা প্রাচ্যের কোথাও আমি এত বড় পাগড়ী ব্যবহার করতে দেখিনি। সেখানকার জ্ঞানী লোকদের ভেতর আরেকজন ছিলেন ধর্মপ্রাণ তাপস বোরহান উদ্দিন। আলেকজান্দ্রিয়ায় থাকাকালে তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম এবং তাঁর আতিথ্যে তিনদিন কাটিয়েছিলাম। একদিন তার কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি বললেন, “আমি দেখছি বিদেশে সফর করতে তুমি খুব ভালবাস।”
আমি উত্তর দিলাম, “জী, হাঁ।” (যদিও তখনও ভারতের বা চীনের মত দূরদেশে সফরে যাবার সঙ্কল্প আমার ছিল না।)
তখন তিনি পুনরায় বললেন, “ভারতে কখনো গেলে তুমি নিশ্চয়ই আমার ভাই ফরিদ উদ্দিনের(১৩) সঙ্গে দেখা করবে, সিন্ধে দেখা করবে ভাই রোকনউদ্দিনের সঙ্গে এবং চীনে গেলে দেখা করবে বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। দেখা করে তাদের কাছে আমার শুভেচ্ছা জানাবে।”
তার ভবিষ্যদ্বাণী শুনে আমি বিস্মিত হলাম। তখন থেকেই এসব দেশে যাবার ইচ্ছা আমার অন্তরে বদ্ধমূল হয়। উল্লিখিত তিন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা না-করা পর্যন্ত আমি সফরে রত ছিলাম।
আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থান কালে শেখ আল মুরসিদি নামক একজন ধার্মিক লোকের কথা শুনেছিলাম। তিনি অলৌকিক উপায়ে যে কোন জিনিস তৈরি করে প্রার্থীর সামনে হাজির করতে পারতেন। একটি নির্জন স্থানে গহ্বরে তিনি বাস করতে যেতেন। নানা শ্রেণীর অসংখ্য লোক দল বেঁধে যেত তার সঙ্গে দেখা করতে। তাদের সবার আহার্য সরবরাহ করতেন তিনি নিজে, তারা প্রত্যেকে বিভিন্ন রকমের মাংস, ফলমূল, মিষ্টি খাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করত। সে সব দুষ্প্রাপ্য হলেও এবং মৌসুমের অনুপযোগী হলেও তিনি তা সামনে এনে হাজির করতেন। মানুষের মুখে-মুখে তার খ্যাতি এতদূর বিস্তৃতি লাভ করেছিল যে সুলতান নিজেও একাধিক বার তার আস্তানায় এসে দেখা করেছেন।
শেখের সঙ্গে দেখা করবার উদ্দেশ্যে আমি একদিন আলেকজেন্দ্রিয়া থেকে রওয়ানা হলাম। সামানহার ছাড়িয়ে সুন্দর শহর ফাবা (fva) গিয়ে পৌঁছলাম। শহরের পাশে একটি খাল। খালের অপর পারে শেখের আস্তানা। দ্বিপ্রহরের মাঝামাঝি সময়ে আমি গিয়ে পৌঁছলাম সেখানে। শেখকে সালাম করে দেখতে পেলাম সুলতানের একজন দেহরক্ষী রয়েছে তার কাছে। একটু দূরে দলবল সহ তিনি তাবু ফেলেছিলেন। শেখ উঠে আমার সঙ্গে কোলাকুলি করলেন এবং কিছু ফল আনিয়ে আমাকে খেতে দিলেন।
আসরের নামাজের সময় হলে তিনি আমাকে এমামের পদে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যতদিন তার সঙ্গে ওখানে ছিলাম তিনি প্রতি ওয়াক্তেই আমাকে এমামতি করতে বলেছেন। শোবার সময় হলে তিনি আমাকে বললেন, “ছাদের উপরে গিয়ে শুয়ে থাকো।” (তখন গ্রীষ্মের গরম কাল)।
আমি বললাম, “বিসমিল্লাহ”।(১৪) তিনি কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে জবাব দিলেন, “আমাদের ভেতর এমন কেউ নেই যার জন্য জায়গা নির্দিষ্ট নেই।”
আমি তখন গিয়ে আস্তানার ছাদের উপরে গিয়ে উঠলাম। সেখানে দেখতে পেলাম একটি খড়ের তোশক, চামড়ার বিছানা, একপাত্র উজুর পানি, এক সোরাহী খাবার পানি, আরেকটি পানপাত্র। আমি সেখানেই শুয়ে পড়লাম।
সেই রাত্রে শেখের বাসস্থানের ছাদে ঘুমন্ত অবস্থায় আমি স্বপ্নে দেখলাম, বিরাটাকার একটি পাখির ডানার উপর চড়ে আমি মক্কার দিকে উড়ে চলেছি। সেখান থেকে ইয়েমেন, ইয়েমেন থেকে পূর্ব দিকে। তারপরে কিছুদূর দক্ষিণে গিয়ে দূর পূর্বাঞ্চলের দিকে। সর্বশেষে নামলাম গিয়ে কালো ও সবুজ এক দেশে। এ স্বপ্ন দেখার পর বিস্মিত হয়ে আমি মনে-মনে ভাবতে লাগলাম, “শেখ যদি আমার এ স্বপ্ন সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন তবেই বুঝব লোকে যা বলে সত্যিই তিনি তাই।”
পরের দিন ভোরে সমস্ত দর্শনেচ্ছু লোক বিদায় নিলে শেখ আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমার স্বপ্নের বিবরণ শুনে তিনি ব্যাখ্যা করলেন, “তুমি মক্কায় হজ ব্রত পালন করবে, মদিনায় হজরতের রওজা মোবারকও জেয়ারত করবে। তারপর সফর করবে ইয়েমেন এবং তুর্কীদের দেশ ইরাক। সেখান থেকে যাবে ভারতে। আমার ভাই দিলশাদের সঙ্গে ভারতে তোমার সাক্ষাৎ হবে। ভারতে তোমাকে অনেকদিন কাটাতে হবে। সেখানে গিয়ে তোমার এক মুসিবৎ হবে এবং আমার ভাই দিলশাদ তোমাকে উদ্ধার করবে সেই মুসিবতের কবল থেকে।” এই বলে পথের সম্বল স্বরূপ তিনি আমাকে ছোট-ঘোট কয়েকখানা পিঠা দিলেন আর দিলেন কিছু অর্থ। আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। তার কাছ থেকে বিদায়ের পরে পথে কখনও আর বিপদে-আপদে পড়তে হয়নি। তাঁর শুভেচ্ছা সর্বক্ষণ আমার পথের সাথী হয়ে রয়েছে।
এখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে আগের অনেকগুলি শহর পার হয়ে পৌঁছলাম গিয়ে ভামিয়েটা। পথে প্রতি শহরেই আমরা সেখানকার ধর্মনেতার সঙ্গে দেখা করেছি। তামিয়েটা শহর নীলনদের তীরে অবস্থিত। নদীর তীরস্থ গৃহের বাসিন্দারা বালতি করে নদীর পানি নিয়ে ব্যবহার করে। অনেক বাড়ির সিঁড়ি নেমে এসে নদীর পানি ছুঁয়েছে। লোকদের ছাগল-ভেড়া সারা দিন-রাত স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে দেখতে পেলাম। সেজন্য ভামিয়ো সম্বন্ধে প্রবাদ আছে, “এ শহরের দেয়ালগুলো মিঠাই, কুকুরগুলো ভেড়া।” এ শহরে একবার প্রবেশ করলে শাসনকর্তার অনুমতি ছাড়া শহর ত্যাগ করে যেতে পারে না। খ্যাতনামা লোকদের কাছে শাসনকর্তার শীলমোহরাঙ্কিত এক টুকরা কাগজ থাকে যাতে তারা দ্বাররক্ষীকে তা দেখিয়ে দরকার মত বাইরে যেতে পারেন। অন্যান্য লোকদের শিলমোহর আছে তাদের নিজ-নিজ বাহুতে। এ শহরে অনেক সামুদ্রিক পাখি আছে। এসব পাখির গোশত আঁঠার মত। এছাড়া এখানকার মহিষের দুধ যেমন মিষ্টি তেমনি সুস্বাদু। এখানকার বুড়ি(১৫) নামক মাছ সিরিয়া, আনাতোলিয়া, কায়রো প্রভৃতি শহরে চালান হয়ে যায়। বর্তমান শহরটি হালে নির্মিত। পুরাতন ভামিয়েটা শহর আল-মালিক আস্-সালের (১৬) আমলে ফ্রাঙ্কদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।