জবাবে তিনি বললেন, “তোমার সঙ্কল্প যদি তাই হয় তবে তোমার গাধাটা এবং ভারী বোঝা বিক্রি করে ফেলো। তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু আমি তোমাকে ধার দিব। তা হলে তুমি হালকা হয়ে সফর করতে পারবে। আমাদের দ্রুত পথ চলতে হবে, কেন না, পথে আরব দস্যুদের ভয় আছে।” (৬)
তার পরমর্শ মতই আমি কাজ করলাম এবং তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। আল্লাহ্ তার কল্যাণ করুন।
কুসানটিনায় (Constantise) পৌঁছে আমরা তাবু ফেললাম শহরের বাইরে কিন্তু রাত্রে অত্যধিক বৃষ্টি হওয়ায় আমরা তাবু ত্যাগ করে নিকটবর্তী একটি গৃহে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম। পরের দিন শহরের শাসনকর্তা এলেন আমাদের দেখতে। বৃষ্টির দরুন আমার পরিধেয় জামা কাপড় অপরিষ্কার হয়েছে দেখে তিনি সে সব তার গৃহে পরিষ্কার করবার হুকুম দিলেন। আমার পুরাতন ও ছিন্ন পাগড়ীর পরিবর্তে তিনি সিরিয়ার উত্তম কাপড়ের একটি পাগড়ী দিলেন। সেই পাগড়ীর এক খুটে বাঁধা ছিল দুটি সোনার দিনার। সফরে বেরিয়ে এই প্রথম আমি অন্যের সাহায্য গ্রহণ করলাম। কুসানটিনা। থেকে আমরা গেলাম বোন। এখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর আমাদের সঙ্গী সওদাগরদের রেখে আবার আমরা যাত্রা করলাম এবং দ্রুত পথ চলতে লাগলাম। পথে আমি আবার জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তাই, শারীরিক দুর্বলতার জন্য পড়ে যাই ভয়ে পাগড়ীর কাপড় দিয়ে ঘোড়ার জিনের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে রাখতে হয়েছিল। আমার এত ভয় হয়েছিল যে তিউনিসে পৌঁছবার আগে আর আমি ঘোড়ার থেকে নিচে নামিনি। সমস্ত শহরের বাসিন্দা এসে জমায়েত হল আমাদের দলের লোকজনের সঙ্গে দেখা। করতে। চারদিকেই আদর আপ্যায়ন এবং কুশল প্রশ্নাদি জিজ্ঞাসার ছড়াছড়ি। কিন্তু আমিও একমাত্র অপরিচিত লোক বলে একটি প্রাণীও আমার দিকে ফিরে তাকাল না। নিজের এই একাকিত্বে আমি এতটা অভিভূত হয়ে পড়লাম যে অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না; আমি কেঁদে ফেললাম। তখন অপর একজন হজযাত্রী আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এগিয়ে এলেন আমাকে সান্ত্বনা দিতে। তিনি আমার সঙ্গে সদয় ব্যবহার করলেন এবং শহরে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে চললেন।
তখন তিউনিসের সুলতান ছিলেন দ্বিতীয় আবু জাকারিয়ার পুত্র আবু ইয়াহিয়া। শহরে সে সময়ে কয়েকজন খ্যাতনামা জ্ঞানীলোকও ছিলেন।(৭) আমার সেখানে অবস্থিতিকালেই রমজানের শেষে ঈদল ফেতর উদযাপিত হয়। আমি জমায়েতে যোগদান করি।(৮) শহরের বাসিন্দারা মূল্যবান পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে বিপুল সংখ্যায় এসে উৎসবে যোগদান করে। সুলতান আবু ইয়াহিয়া এলেন অশ্বারোহণে। তার পশ্চাতে মিছিল করে পদব্রজে এলেন সমস্ত আত্মীয়স্বজন এবং সরকারী কর্মচারীগণ। ঈদের নামাজ ও খোদ্যার শেষে সবই স্ব-স্ব গৃহে ফিরে গেল।
কিছুদিন পরে হেজাজ গমনেচ্ছু যাত্রীদের একটি কাফেলা ঠিক হল। আমাকে তারা মনোনীত করল কাজী। নবেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমরা তিউনিস ত্যাগ করে সমুদ্রোপকূলের পথে মুসা, স্কাল্প (sfax) ও কাবিস (৯) অতিক্রম করলাম। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির জন্য কাবিসে আমাদের দশ দিন কাটাতে হল। সেখানে থেকে আমরা ত্রিপলী রওয়ানা হলাম। একশ’ বা আরও অধিক অশ্বারোহী এবং একদল তীরন্দাজ অনেক দূর। অবধি আমাদের সঙ্গী ছিল। স্কাসে থাকতে তিউনিসের একজন রাজকর্মচারীর কন্যার। সঙ্গে আমার বিবাহের কথাবার্তা স্থির হয়। ত্রিপলীতে তাকে আমার নিকট আনা হয়। কিন্তু ত্রিপলী ত্যাগ করবার পরেই তার পিতার সহিত আমার মনোমালিন্যের ফলে তাকে আমি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হই। অতঃপর আমি ফেজের একজন ছাত্রের এক কন্যাকে বিবাহ করি। বিবাহের সময় একদিন অপেক্ষা করে সবাইকে আমি এক ওয়ালিমার ব্যবস্থা করি।
অবশেষে ৫ই এপ্রিল, ১৩২৬ খ্রীস্টাব্দে আমরা আলেকজান্দ্রিয়া এসে পৌঁছলাম। চারটি সিংহদ্বার (১০) বিশিষ্ট একটি সুন্দর বন্দর-যেমন সুগঠিত তেমনি সুরক্ষিত। সারা দুনিয়ায় যে সব বন্দর আমি দেখেছি, তার ভেতর কালাম (guilon), ভারতের কালিকট, তুর্কীর সুডাক এবং চীনের জয়তুন ছাড়া আলেকজান্দ্রিয়ার সমকক্ষ আর কোন বন্দর নেই। এসব বন্দরের বিবরণ আমি পরে প্রদান করব। এখানে এসেই আমি বাতিঘর দেখতে গেলাম। এর একটি দিক তখন প্রায় ধ্বংসসানুখ। চতুষ্কোণ বিশিষ্ট বেশ উঁচু একটি অট্টালিকা। মাটীর চেয়ে অনেক উঁচতে এর প্রবেশদ্বার। বাতিঘরের উল্টা দিকে আছে সমান উঁচু অপর একটি দালান। সেখান থেকে প্রবেশদ্বার অবধি একটি কাঠের পুল। এটি সরিয়ে নিলে বাতিঘরে প্রবেশের আর কোন উপায় থাকে না। দরজার পরেই বাতিঘর রক্ষকের বাসস্থান। বাতিঘরের ভেতরের অনেকগুলি কামরা। বাতিঘরের ভেতরের রাস্তাটি নয় বিঘত প্রশস্ত এবং দেওয়াল দশ বিঘত পুরু। বাতিঘরের প্রতিটি পাশের মাপ ১৪০ বিঘত। শহর থেকে তিন মাইল দূরে সমুদ্রের দিকে শহরের প্রাচীর। ঘেষে লম্বা হয়ে এগিয়ে গেছে একখণ্ড ভূমি। তার একটি উঁচু ঢিবির উপর এ বাতিঘর। কাজেই শহর থেকে ছাড়া বাতিঘরে স্থলপথে পৌঁছবার আর কোনই পথ নেই। ৭৫০ হিজরীতে (১৩৪৯ খ্রীস্টাব্দ) পশ্চিম অঞ্চলে ফিরে এসে পুনরায় আমি বাতিঘরটি দেখতে যাই। তখন এটি এমন জীর্ণ দশায় এসে পৌঁছছে যে এতে প্রবেশ আর নিরাপদ মনে হল না।(১১) আল-মালিক আন-নাসির পাশেই অপর একটি বাতিঘর নির্মাণ আরম্ভ করেন কিন্তু বাতিঘরের নির্মাণ কার্য শেষ হবার আগেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।