শিয়া মতবাদ বরাবরই গোঁড়া বা প্রচলিত মতাদর্শ অপেক্ষা অধিকতর উগ্র সাম্প্রদায়িকতার পরিবাহক। পূর্ব হতেই শিয়া মতবাদের প্রভাবে শিয়াগোষ্ঠীর শাখা প্রশাখার জন্য বিভিন্ন মতবাদের প্রভাব শিয়াগোষ্ঠীর শাখা-প্রশাখা কালে হজরত আলী ও তার বংশধরদের প্রতি এক চরম মত পোষণ করতে থাকে, এমন কি তাদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতেও দেখতে আরম্ভ করে। এই চূড়ান্ত পন্থীরা (ghulat) সিরিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয়েছিল বলে মনে হয়। আজও সেখানে বাস্তবিক পক্ষে ড্রস (Druse) ও নুসাইরিন (অধুনা আলাবিস) নামক সর্বশ্রেষ্ঠ গোত্র দু’টির পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায় দ্বাদশী দলের অধিকাংশকে যারা স্থানীয় লোকদের কাছে মোতাওয়াল্লি নামে পরিচিত। এই সহ-অবস্থানের ফলেই তাদের ভেতর এ অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি। শিয়ারা যেখানে ঘৃণার চোখে দেখে সুন্নীরা সেখানে অপছন্দ মাত্র প্রকাশ করে। শিয়াদের ঘৃণা যে কেবল অমুসলমানদের প্রতি তা নয়, ভিন্ন পথাবলম্বী মুসলমানদের–বিশেষ করে সুফিদেরও তারা ঘৃণা করে। কারণ, সূফিরাও শিয়া মতবাদ অনুমোদন করে না। এক সম্প্রদায়ের প্রতি অপর সম্প্রদায়ের এ-ধরনের বিরূপ মনোভাবের দরুনই মামলুক শাসনামলেও সেখানে দলাদলি ও বিভেদ মাথা তুলে আছে। ইবনে বতুতার ভ্রমণ-বিবরণীতে শিয়া সুন্নীর শক্রতার কথা একাধিক বার উল্লেখিত হয়েছে। অবশ্য যদিও ইবনে বতুতা শিয়া বা আলবিন এর স্থলে কুখ্যাত ‘রাফিজ’ বা প্রত্যাখ্যানকারী শব্দ ব্যবহার করেছেন তবু তার ব্যক্তিগত মতামত বা বিদ্বেষ মূল বক্তব্যকে কোন অংশে বিকৃত করেনি। ইমাম বা ধর্মীয় নেতা নিয়োগে শিয়া সম্প্রদায় যে নীতি অনুসরণ করত তাতে পরোক্ষভাবে এসব নামের উদ্দেশ্য ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। শিয়া সম্প্রদায় মনে করত যে একমাত্র হজরত আলীই তাঁর জাতি ভ্রাতা হজরত মোহাম্মদের (দঃ) স্থলাভিষিক্ত হবার যোগ্য ছিলেন এবং পূর্বে যে তিন জন খলিফা রাজ্য চালনা করে গেছেন তাদের শিয়ারা বিশ্বাসঘাতক ও পরস্পাপহারী বলে আখ্যায়িত করেছে। ধর্মপ্রাণ সুন্নী মুসলমান হজরত মোহাম্মদের (দঃ) নিকট-অনুচর বা আস্হাব হিসাবে উক্ত খলিফাদের নামের পরে সম্মানসূচক আশীবাণী উচ্চারণ করে কিন্তু তৎপরিবর্তে শিয়ারা করে অভিশাপ। শিয়াদের বিভিন্ন বিরোধী রীতি-নীতি ও মতামত অপেক্ষা খলিফাদের প্রতি তাদের অপমানসূচক আচরণই সুন্নী মুসলমানদের ক্রোধ ও বিদ্বেষের উদ্রেক করেছে বেশি।
এইচ. এ. আর. গিব
০১. জন্মভূমি তাঞ্জির ত্যাগ
০১.
হিজরী ৭২৫ সালের ২রা রজব, বৃহস্পতিবার (১৪ই জুন, ১৩২৫ খ্রী:) বাইশ বৎসর বয়সে মক্কার কাবা শরীফে হজব্রত পালন ও মদিনায় রসুলের রওজা মোবারক জেয়ারতের উদ্দেশ্য আমি জন্মভূমি তাঞ্জির ত্যাগ করি। পথের সাথী হিসাবে কোন বন্ধু বা ভ্রমণকারী না পেয়ে আমাকে একাকীই রওয়ানা হতে হয়। উল্লিখিত পবিত্র স্থানগুলি দর্শনের অদম্য আবেগ ও বাসনা নিয়া আমি প্রিয় বন্ধুবান্ধব ও গৃহের মায়া কাটাইতে সংকল্প করি। তখনও আমার পিতামাতা জীবিত ছিলেন। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে আমার মনে যেমন কষ্ট হয়েছিল তাদের মনেও ঠিক তেমনি কষ্টই হয়েছিল।
তিলিম্যান (Tlemsen) শহরে পৌঁছে আমি তিউনিসের সুলতানের দু’জন রাষ্ট্রদূতের দেখা পেলাম। তখন তিলিম্যাসনের সুলতান ছিলেন আবু ওশিফিন।(২) আমি যেদিন সেখানে পৌঁছলাম সেদিনই রাষ্ট্রদূত দু’জন শহর ত্যাগ করে রওয়ানা হয়ে গেছেন। আমার একজন বন্ধু তাদের সঙ্গী হতে আমাকে পরামর্শ দিলেন। আমি এ বিষয়ে ইতিকর্তব্য চিন্তা করতে লাগলাম (৩) এবং তিন দিন সে শহরে কাটিয়ে যাত্রার সমুদয় আয়োজন শেষ করে ঘোড় নিয়ে দ্রুত তাঁদের অনুগমন করলাম। তাদের নাগাল। পেলাম মিলিয়ানা শহরে। অত্যধিক গরমে দুজন রাষ্ট্রদূতই পীড়িত হয়ে পড়েছিলেন। বলে আমাদের দশ দিন সে শহরে কাটাতে হল। আমরা পুনরায় রওয়ানা হবার পরে একজন রাষ্ট্রদূতের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠল। মিলিয়ানা শহর থেকে চার মাইল দূরে একটি নদীর পারে তিন রাত্রি কাটাবার পরে তিনি এন্তেকাল করলেন। আমি তাদের সঙ্গ সেখানেই ত্যাগ করলাম এবং তিউনিসের সওদাগরদের একটি কাফেলায় যোগদান করে পথ বলতে লাগলাম। এভাবে আল-জাজাইর (Algiers) পৌঁছে শহরের বাইরে আমাদের দিন কয়েক কাটাতে হল। আমাদের আগে একটি দল রওয়ানা হয়ে এসেছিল। তারা এসে পৌঁছলে একত্র হয়ে আমরা মিটিজার(৪) ভেতর দিয়ে ওয়াকস্ (জুরজুরা) পর্বত পার হয়ে বিজায়া (Bougie)(৫) পৌঁছলাম। তখন বিজয়ার সেনানায়ক ছিলেন ইবন সাইয়েদ আনাস। সেখানে পৌঁছবার পর আমাদের সঙ্গে তিন হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিনার ছিল। তার ওয়ারিশদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য সে আগেই তা আলজিয়ার্সের একজন লোকের হাতে সঁপে দিয়েছিল। ইব্নে সায়ইদ আনাস এ খবর পেয়ে বলপ্রয়োগে সে অর্থ আত্মসাৎ করে নিলেন। তিউনিসিয়া সরকারের কর্মচারীদের অত্যাচারের দৃষ্টান্ত এই প্রথম দেখলাম। বিজায় থাকতে আমি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম। তাই দেখে আমার এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন আরোগ্য না হওয়া অবধি সেখানে থেকে যেতে। কিন্তু আমি সে প্রস্তাবে সম্মত না হয়ে বললাম, “আমার মৃত্যু যদি খোদার ইচ্ছে হয়ে থাকে, তবে মক্কার দিকে মুখ করে পথেই মৃত্যুবরণ করব।”