অবশ্য ইবনে বতুতা যে দরবেশ ও সুফীদের প্রতি একটু অতিরিক্ত অনুরাগী সহানুভূতিশীল হবেন তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। মোটামুটি প্রায় সব ধর্মোপদেষ্টাই এসব দরবেশের প্রতি বিরোধভাবাপন্ন না হলেও সন্দেহপ্রবণ। এর মূলে ধর্মীয় ও পার্থিব উভয়বিধ একাধিক কারণ রয়েছে। পক্ষান্তরে ‘মিষ্টিক বা অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও এ সমস্ত ধর্মতত্ত্বজ্ঞানীদের অহরহ অবজ্ঞার চোখে দেখতেন বিশেষ শ্রেণীর ধর্মমতকে তারা আঁকড়ে ধরে থাকতেন বলে। ধর্মীয় শিক্ষার প্রকারভেদই এদের মধ্যে। বিরোধের প্রথম কারণ ছিল। ধর্মতত্ত্বাপদেষ্টাদের জন্য সত্যোপলব্ধির পথ ছিল মাত্র একটি এবং তা ছিল ইলম বা ধর্মতত্ত্ব বিজ্ঞান–যার অঙ্গীভূত রয়েছে যথারীতি কোরআন ও হাদিসের চর্চা। পক্ষান্তরে দরবেশদের মতে সত্যদর্শনের উপায় ছিল মারিফা। তারা বরং বাধার সৃষ্টিই করে। সূফী মতবাদ ছিল প্রচলিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিপন্থী। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যারা আস্থাবান তারা সূফীমতবাদ মেনে নিতে পারেন না। কারণ তারা ছিলেন ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলার একান্ত পক্ষপাতী। অধিকন্তু শেখের শিষ্যগণ যেভাবে জীবিতাবস্থায় তাঁদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত এবং সাধুর পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টায় তাদের নামে খোত পর্যন্ত পাঠ করত, ধর্মতত্ত্বজ্ঞানীদের কাছে তা ছিল ধর্মীয় অমঙ্গলের চিহ্নস্বরূপ, এমনকি একেশ্বরবাদের বিরোধী, ইসলামের দৃষ্টিতে যা ঘোর পাপ বলে পরিগণিত। প্রথমাবস্থায় সূফী এবং ধর্মোপদেষ্টাদের মধ্যে বিরোধে। ফাটল প্রশস্তই ছিল কিন্তু কালক্রমে তা সংকীর্ণ হয়ে আসে। কারণ, সূফীমতবাদ কিছুটা জনপ্রিয়তালাভ করে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধর্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিপূজার ব্যাপারে আপোষ মীমাংসায় আসতে বাধ্য হয় ধর্মীয় ক্ষেত্রের বাইরেও সূফীমতবাদের যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল। এবং সে প্রাধান্যই সূফীমতবাদ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিল। দেখা যাচ্ছে, তারা একটি পৃথক ধর্মীয় গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেছিল। জনপ্রিয়তা লাভের প্রচেষ্টায় এ উভয় মতবাদের মধ্যেই একটা প্রতিযোগিতার ভাব বিদ্যমান ছিল। অতঃপর ইসলামের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে তুর্কীদের অনুপ্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গে সূফীমতবাদই জনপ্রিয়তালাভে সমর্থ হয়। তার ফলস্বরূপ ধর্ম তত্ত্বজ্ঞানীরা এতদিন যা মানেনি তার অনেক কিছুই মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যেই তাদের এ আত্মসমর্পণ চূড়ান্তভাবে পরিসমাপ্তি লাভ করে সূফীমতবাদবিরোধীদলের পুরোধা ইবনে তায়মিয়ার আত্মবিলুপ্তির সঙ্গে-সঙ্গে। ইবনে বতুতা দামেশকে ইবনে তায়মিয়ার সাক্ষালাভ করেন। কিন্তু উভয় মতবাদের এ বৈরীভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে চলতেই থাকে। অন্যান্য জায়গার তুলনায় উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় এভাব ছিল কম। সম্ভবতঃ বারবার জাতির স্বধর্মের প্রতি জন্মগত আনুগত্যই ছিল তার মূল কারণ। ধর্ম ও ধর্মপ্রাণ পূণ্যাত্মা ব্যক্তিদের প্রতি তাদের আনুগত্য বা ‘মুরাবিত’ আজও বিদ্যমান আছে। ইবনে বতুতা নিজে একজন শিক্ষাপ্রাপ্ত ধর্ম তত্ত্বোপদেষ্টা হয়েও কেন যে বারবারদের মত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ অনুগত ছিলেন তার জবাব আমরা সম্ভবতঃ এখানেই পেতে পারি।
সূফী এবং ধর্মশাস্ত্রানুসারী দলের ভেতর যে বৈরীভাব ছিল তা শিয়া ও সুন্নীগোত্রের বিরোধের তুলনায় একান্ত নগণ্য ছিল বলতে হবে। ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে উমাইয়া বংশের খলিফাদের বিপক্ষে রসুলুল্লাহর জামাতা হজরত আলীর পক্ষে যে প্রচারণা চলে তাকে কেন্দ্র করেই শিয়াগোত্রের উৎপত্তি। এ-সময়ে প্রচলিত ধর্মমতে যারা বিশ্বাসী তাদের সঙ্গে শিয়া মতাবলম্বীদের বিরোধিতা প্রবল রূপ ধারণ করে। তার ফলে জনসাধারণ শিয়া-দর্শনের ঐতিহাসিক মূল্যবোধ উত্তমরূপে উপলব্ধি করে নিন্দিত। উমাইয়া বংশের মূলোৎপাটনে সহায়তা করে। কিন্তু প্রকারান্তরে জনসাধারণ অধিকতর স্বৈরাচারী শাসনের কবলে নিপতিত হল আব্বাসীয় আমলে। এই সময়ে শিয়া মতবাদ ভিন্ন একরূপ পরিগ্রহ করল। তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, প্রচলিত রীতিতে খলিফা নির্বাচন বাদ দিয়ে তারা খোদা কর্তৃক নিযুক্ত নিষ্পাপ ও অপ্রতিদ্বন্ধী একজন ধর্মীয় নেতা বা ‘ইমাম’ নিয়োগ করল। তারা বংশানুক্রমে হজরত আলীর গোষ্ঠী হতেই ইমাম। গ্রহণের পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু কতিপয় উপগোষ্ঠীর বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হল না। এসব গোষ্ঠীর প্রধান ছিল দ্বাদশী দল। ইরাক ও ইরানের শিয়া সম্প্রদায় আজও এ-গোষ্ঠীভুক্ত বলে নিজেদের পরিচয় দেয়। তাদের বিশ্বাস, ৮৭৩ খ্রীস্টাব্দে দ্বাদশ ইমাম হিল্লার নিকটবর্তী এক পর্বতগুহায় অন্তর্ধান করেন, আজও তিনি তাঁর অনুসারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আত্মিক ও পার্থিব কার্যের পথপ্রদর্শকরূপেই আছেন। অধিকন্তু তিনিই একদিন প্রতিশ্রুত ইমাম মেহদীরূপে আবির্ভূত হয়ে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাবেন। লুক্কায়িত ইমামের–যাঁকে ‘যুগশ্রেষ্ঠ’ আখ্যাও দেওয়া হয় অপূর্ব মতবাদ স্মরণীয় করা হয় হিল্লার পাদদেশে আয়োজিত উৎসবের নানা রকম অনুষ্ঠানে। ইবনে বতুতা এ উৎসবের একটি হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে।