এ স্থানটি ত্যাগ করে দশ দিন পথ চলার পর আমরা হাগৃগারদের দেশে পৌঁছি। এরা অসভ্য শ্রেণীর লোক এবং মুখে আবরণ ব্যবহার করে। আমরা একবার তাদের এক সর্দারের কবলে পড়েছিলাম। সে আমাদের কাফেলা আটক করে রাখে। পরে মুক্তিমূল্য স্বরূপ কয়েকটি বস্ত্রখণ্ড ও অন্যান্য জিনিষ দিয়ে আমরা রেহাই পাই। আমরা যখন এদের দেশে পৌঁছি তখন রমজান মাস চলছে। রমজান মাসে তারা কোনো কাফেলার উপর হামলা করে না। এ সময়ে পথে ঘাটে জিনিস পত্র ফেলে রাখলেও তাদের দস্যুরা অবধি সে সব জিনিষ স্পর্শ করে না। এ পথের ধারে সমস্ত অসভ্য জাতির মধ্যেই এ রীতিটি প্রচলিত। এক মাস আমরা হাগগারদের দেশের ভেতর দিয়ে চলেছি। অঞ্চলটি গাছপালাহীন প্রস্তরময় এবং রাস্তাঘাটও খারাপ। ঈদ-উল-ফেতরের দিনে আমরা যেখানে পৌঁছি সেখানকার লোকেরাও অসভ্য এবং তারাও মুখাবরণ ব্যবহার করে।
অতঃপর আমরা আবাতের প্রসিদ্ধ গ্রাম বুদা পৌঁছি। এখানকার জমি বালুকাময় ও লবণাক্ত। এখানে প্রচুর খেজুর পাওয়া যায় কিন্তু তা সুস্বাদু নয়। তবু স্থানীয় লোকেরা। সিজিলমাসার খেজুরের চেয়েও এখানকার খেজুর বেশী পছন্দ করে। এখানে কোনো রকম ফসল, মাখন বা জলপাইর তেল পাওয়া যায় না। পশ্চিম অঞ্চলের দেশ থেকে এসব জিনিস এখানে আমদানী হয়। খেজুর ও পঙ্গপাল এখানকার অধিবাসীদের খাদ্য। এখানে যথেষ্ট পঙ্গপাল দেখা যায়। খেজুরের মতই এরা পঙ্গপাল সগ্রহ করে রাখে খাদ্য হিসাবে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য। ঠাণ্ডায় পঙ্গপাল উড়ে পালাতে পারে না বলে তারা সূর্যোদয়ের আগে পঙ্গপাল ধরতে যায়।
বুদায় কয়েকদিন কাটিয়ে আরেকটি কাফেলার সঙ্গে জেলকদ মাসের মাঝামাঝি সিজিলমাসায় গিয়ে পৌঁছি। সেখান থেকে জেলহজ্ব মাসের ২রা তারিখে (২৯শে ডিসেম্বর) আমি অসহ্য শীতের মধ্যে তুষারাবৃত পথে রওয়ানা হই। জীবনে বুখারা, সমরকন্দ ও খোরাসানে অনেকবারই তুষারাচ্ছন্ন বন্ধুর পথ দেখেছি, তুকাদের দেশেও সে সব দেখেছি কিন্তু উন্মে জুনায়বার পথের মত খারাপ পথ কোথাও দেখিনি। ঈদ-উল ফেতর পর্বের পূর্বক্ষণে আমি দার-আত-তামা এসে পৌঁছি। রমজানের পরে ভোজনোৎসবের দিনটি আমার সেখানেই কাটে। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে আমি আমাদের খলিফার রাজধানী ফেজ এসে পৌঁছি। এখানে আমির-উল-মমামেনি রে দস্ত মুবারক চুম্বনের ও তাকে দর্শনের সুযোগ ও সৌভাগ্যলাভ করি। আল্লাহ তার শক্তি বৃদ্ধি। করুণ এই আমার কামনা। দীর্ঘ সফরের পর আমি তার স্নেহচ্ছায়ায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। তিনি আমার প্রতি যে অপরিসীম অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন সেজন্য পরম করুনাময় আল্লাহ তার মঙ্গল করুন এবং তাকে দীর্ঘজীবি করুন যাতে তিনি মুসলমানদের কল্যাণ করে যেতে পারেন।
এখানেই A Donation to those interested in the curiosities of the cities and Marvels of the Ways শীর্ষক সফরনামা শেষ হয়েছে। এ সফরনামার তলিখন সমাধা হয় ৭৫৬ হিজরীর ৩রা জেলহজ্ব (৯ই ডিসেম্বর ১৩৫৫)। আমি আল্লার প্রশংসা ঘোষণা করছি এবং তাঁর প্রিয় যারা তাদের শান্তি কামনা করছি।
ইব্নে জুযাই বলছেন, “শেখ আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইব্নে বতুতার বর্ণিত ও আমার দ্বারা সংক্ষেপিত বর্ণনা এখানেই শেষ হল। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সহজেই স্বীকার করবেন যে শেখ ইব্নে বতুতা তার যুগের একমাত্র সফরকারী। কেউ যদি বলেন যে তিনি ছিলেন মুসলিমদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সফরকারী তবে তিনি অতিশয়োক্তি করলেন বলা যায় না।”
-সমাপ্ত-
***
টিকা
পরিচ্ছেদ ১৪
১। আট এবং মোল শতাব্দীর মাঝখানে আটলা পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত সিজিলমাসা ছিল একটি প্রধান বাণিজ্যি ঘাঁটি। পুরানো শহরের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে ওয়াদি জিজের পাঁচ মাইল ব্যাপি স্থানের উপরে আধুনিক টাফিলেতের নিকটে।
২। তগহাজার নিমক-খনি তাওদেনির উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। নিমকের জন্য এ স্থানটি নিগ্রো সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।
৩। ওয়াদি দ্রা এন্টি-আট্রাসের ঢালুকে পরিত করে। মাসুফা নামটি মনে হয় সে সময়ে সাহাজাকে দেওয়া হয়েছে-এটা ল্যামৃতুনা সহ স্মরণাতীত কাল থেকে পশ্চিম সাহারার প্রধান। বংশ ছিল। ইব্নে বতুতার বিবরণ অনুসারে মাসুফা তাগৃহাজা থেকে তিমবুক পর্যন্ত এবং পূর্বদিকে এয়ার এবং হোগার পর্যন্ত সমস্ত সাহারা অধিকার করেছিল।
৪। গ্রন্থে যে বাক্যাংশটি ব্যবহার করা হয়েছে (এটাকে ক্যন্টারস্ এক্যান্টার বলা যেতে পারে) সেটাকে গ্রহণ করা হয়েছে কোরাণ থেকে। সেখানে এর মানে হচ্ছে “অকথিত সম্পদ।”
৫। সারাল সম্ভবতঃ ইদ্রিসির তাইসার। এটা আজাওয়াদ মরুভূমিতে অবস্থিত (কুলি, ১৪-১৫)।
৬। আইওয়ালাতান হচ্ছে ওয়ালাতার বহুবচন। লিও আফ্রিকানা অনুসারে স্থানটি গঠিত হয়েছে তিনখানা গ্রাম নিয়ে। আধুনিক ম্যাপে ওয়ালা নামে দুটি স্থান দেখা যায়। ইব্নে বতুতার ওয়ালাতান হচ্ছে দক্ষিণেরটি–১৭:০২ উত্তরে, ৬:৪৪ পশ্চিমে। তেরো শতাব্দীতে ট্রান্স সাহারান বাণিজ্য পথের দক্ষিণ টারমিনাস রূপে এটা ঘানার স্থান দখল করেছিল (নিম্নে ২১ টীকা দ্রষ্টব্য)। এটা তৈরি হয়েছিল (হাটম্যান, Mit. Sem. Or. Stud. XV৩. ১৬২ অনুসারে) পুরাতন বার্বার শহর আওদাঘাশতের স্থানে।
৭। বাওবাব গাছ (Adansonia digitata) খুব স্বল্পকাল মধ্যে বৃহৎ ব্যাস লাভ করে থাকে এবং লোকে তার খুঁড়িতে খোড়ল পুড়ে নিয়ে পানি রাখে। সেজন্য যেখানে ইন্দারা নেই সেখানে এ সব গাছ থাকার জন্য জন-বসতী সম্ভব হয়। এ উদ্দেশ্যে আঠারো শতকে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে এ গাছ পূর্ব সুদানে (কর্ডোফান) আমদানী করা হয়। কিন্তু ইব্নে বতুতার বর্ণনায় দেখা যায় কৃত্রিম ফোকড় তৈরি করার কাজ তখনো সেখানে প্রচলিত হয়নি।