তাগাদ্দায় পৌঁছে আমি একজন শিক্ষিতা বাদী কিনতে চাইলাম কিন্তু কোথাও তা পেলাম না। পরে কাজী তার বন্ধুর একটি বাদীকে আমার কাছে পাঠালেন। আমি পঁচিশ মিশকাল দিয়ে তাকে খরিদ করলাম। পরে তার মনিব তাকে বিক্রি করে খুব অনুতপ্ত হ’ল এবং তাকে ফিরিয়ে নিতে চাইল। কাজেই আমি বললাম, “আরেকটি বাদী কোথায় পেতে পারি জানালে আমি একে ফেরত দিতে পারি।”
সে তখন ‘আলী আগিলের একটি বাদীর কথা বলল। এ আলী আগিলই তাদালার সেই মাগরাবিন যে আমার মালপত্র বহন করতে রাজী হয়নি এবং আমার ভৃত্যকে পানি খেতে দেয়নি। কাজেই আমি এ বাঁদীটিকে কিনে প্রথমটি ফেরত দিলাম। এ বাণীটি প্রথমটির চেয়ে ভাল ছিল। পরে মাগরাবিনও তার বাদী বিক্রি করে যথেষ্ট অনুতপ্ত হল ও তাকে ফেরত চাইল। এজন্য সে যথেষ্ট পীড়াপীড়ি করতে লাগল কিন্তু তার দূর্ব্যবহারে প্রতিশোধের জন্য আমি তার প্রস্তাব মেনে নিতে কিছুতেই রাজী হচ্ছিলাম না। অবশেষে সে বাদীর দুঃখে পাগল হয়ে যাবে অথবা মরে যাবে এমন অবস্থা হওয়ায় তার সঙ্গে কেনাবেচা বাতিল করতে হল।
তাম্রখনিটি তাগাদ্দা শহরের বাইরে। তারা খনি থেকে তামা তুলে এনে বাড়ীতে শোধন করে। এ কাজ তাদের গোলাম ও বাদীরাই করে। শশাধিত লাল তামা দিয়ে তারা। অনুমান দেড় বিঘত লম্বা তার তৈরী করে। এ সব তাল হালকাও হয় ভারীও হয়। এক স্বর্ণ মিশকালের পরিবর্তে চার শ ভারী তাল বিক্রি হয়। হালকা তাল হলে ছয় বা সাতশ’ পাওয়া যায় এক মিশকালে। তামার তালের সাহায্যে তাদের বেচা কেনাও চলে। হালকা তাল দিয়ে তারা কিনে মাংস ও জ্বালানী কাঠ এবং ভারী তাল দিয়ে বাদী, গোলাম, ভুট্টা মাখন ও গম।
তাগাদ্দা থেকে তামা রপ্তানী হয় বর্বর দেশের অন্তর্গত কুবার শহরে, জাঘাই৩৬ ও বারনু দেশে। তাগাদ্দা থেকে বারনুর দূরত্ব চল্লিশ দিনের পথ। বারনুর বাসিন্দারা মুসলমান। ইদ্রিস নামে তাদের একজন রাজা আছেন। তিনি প্রজাদের সামনে কখনো দেখা দেন না। এবং পর্দার আড়ালে থেকে ছাড়া তাদের সঙ্গে কখনও কথা ৩৭ বলেন না। এ দেশেই উৎকৃষ্ট বাদী, খোঁজা পুরুষ এবং জাফরাণী রঙে রং করা কাপড় পাওয়া। যায়। তাগাদ্দার তামা অন্যান্য দেশ ছাড়াও জাওজাওয়া এবং মুয়াবতাঁবুনদের দেশে রফতানী হয়।
তাগাদ্দায় থাকা কালে আমি সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করলাম। তিনিও বর্বর সম্প্রদায় ভূক্ত। তাঁর নাম আইজার। তিনি তখন যেখানে ছিলেন শহর থেকে সেখানে যেতে একদিন লাগে। কাজেই একজন চালক নিযুক্ত করে আমি একদিন রওয়ানা হলাম। আমার আগমন সংবাদ পেয়ে তিনি জাজিম বিহীন এক ঘোড়ায় চড়ে দেখা করতে এলেন। ঘোড়ায় জাজিম ব্যবহারের রেওয়াজ তাদের দেশে নেই। জাজিমের পরিবর্তে রয়েছে জাজিমের উপরে দেবার চাকচিক্যময় একটুকরা কাপড়। সুলতানের গায়ে আলখেল্প, পরিধানে পায়জামা, মাথায় পাগড়ী–সবই নীল রঙের। সঙ্গে ছিল তার ভাগনেয়রা। ভাগনেয়রাই তার রাজত্বের উত্তরাধিকারী। তিনি এগিয়ে আসতে আমি উঠে গিয়ে তার করমর্দন করলাম। আমার আগমনের কারণ ও কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলে আমি সবিস্তারে তাকে সব বললাম। তিনি ইয়ানিতিবুননের একটি তাবুতে আমার বাসস্থান নির্দেশ করলেন। এরা আমাদের দেশের বুসকানদের ৩৯ সমতুল্য। আমার আহারের জন্য তিনি পাঠালেন রোস্ট করা একটি ভেড়া এবং কাঠের একটি পাত্রে গোদুগ্ধ। আমাদের তাবুর কাছেই ছিল সুলতানের মাতা ও তার ভগ্নীর তাবু। তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করে সালাম করে গেলেন। মাগরিবের নামাজের পরে তাদের গাভী দোহনের সময়। সুলতানের বাবা সে সময়ে আমাদের দুধ পাঠাতেন। তারা দুধ পান করে সন্ধ্যার পরে এবং ভোরে। খাদ্যশস্যের কিছুই তারা খায় না এবং খেতে জানেও না। তাদের সঙ্গে আমি ছয়দিন ছিলাম। প্রতিদিনই দুটি করে রোস্ট করা ভেড়া–একটি সকালে, একটি সন্ধ্যায় সুলতানের নিকট থেকে আমি পেয়েছি। তা ছাড়া তিনি আমাকে একটি মাদী উট এবং দশ মিশকাল মূল্যের স্বর্ণ দান করেছিলেন। পরে। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাগাদ্দা ফিরে এলাম।
তাগাদ্দায় ফিরে আসার পরেই আমাদের খলিফার এক আদেশ পত্র নিয়ে এক দূত এসে হাজির। তিনি আমাকে তার রাজধানীতে ফিরে যেতে আদেশ করেছেন। আমি তার আদেশপত্রটি চুম্বন করে আদেশ পালনে যত্নবান হলাম। সওয়ারের উপযোগী দুটি উট ৩৭মিশকালে খরিদ করে আমি তাবাত যাত্রার আয়োজন করলাম। সত্তর দিনের উপযোগী খাদ্য সঙ্গে নিলাম কারণ তাগাদ্দা ও তাবাতের মধ্যে কোথাও খাদ্যশস্য পাওয়া যায় না। কাপড়ের টুকরার বিনিময়ে মাংস, দুধ এবং মাখন পাওয়া যায়।
বিশাল একটি কাফেলার সঙ্গে আমি তাগাদ্দা ত্যাগ করলাম ৭৫৪ হিজরীর ১১ই শাবান বৃহস্পতিবার মোতাবেক ১১ই সেপ্টেম্বর ১৩৫৩ খৃস্টাব্দে। আমাদের এ কাফেলায় ক্রীতদাসী ছিল ছয়শ। আমরা প্রথমে কাহির এসে পৌঁছলাম। সেখানে গোচারণ ভূমি প্রচুর। কাহির থেকে এসে জনহীন এক মরুভূমিতে পড়লাম। তিনদিনের পথ বিস্তৃত এই মরুর কোথাও পানি নেই। তারপরে আরেকটি মরুভূমির ভেতর দিয়ে আমরা পনর দিন পথ চললাম। এ মরুভূমিটি জনহীন হলেও এর স্থানে-স্থানে পানি পাওয়া যায়। পনর দিন পর আমরা যেখানে পৌঁছলাম সেখানেই মিরগামী ঘাট নামক সড়ক তাবাক সড়ককে অতিক্রম করেছে। এ অঞ্চলের স্থানে স্থানে ভূগর্ভে পানির ধারা প্রবাহিত হয়। সে ধারা লৌহের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে এ পানির মধ্যে একখণ্ড বস্ত্র ডুবালে তা কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করে।