এমন আরও একটি কর্তব্যভার সমগ্র সমাজের উপর ন্যস্ত ছিল যে ভার কোন। পেশাদার ধর্মোপদেষ্টার উপর দেওয়া সম্ভব নয়। সে কর্তব্য হল তরবারীর দ্বারা ইসলামের ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য রক্ষা করা। কতিপয় ব্যবহার-শাস্ত্রজ্ঞ জেহাদ’কে নামাজ ও রোজার সমপর্যায়ের অবশ্যকরণীয় অনুষ্ঠান বলে গণ্য করেছেন এবং ইসলামের প্রথম যুগে প্রতিটি মুসলমান জেহাদকে আত্মরক্ষার পরিবর্তে আক্রমণাত্মকভাবেই সর্বক্ষণের পেশা বলে গ্রহণ করেছেন । ক্রুসেডের যুদ্ধের দ্বারা এবং খ্রীস্টানদের স্পেন বিজয়ের দ্বারা জেহাদ পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। অবশ্য। ইসলামের রক্ষার্থে প্রতি মুসলমানের অস্ত্রধারণ করা কর্তব্য, এ ধারণা অতঃপর বেশি দিন বজায় থাকেনি। সিরিয়া ও আন্দালুসিয়া রক্ষার ভার তখন দেশের অধিবাসীদের উপরই ন্যস্ত হয়। এতৎসত্ত্বেও ধর্মযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে স্বর্গপ্রাপ্তির লোভ স্বেচ্ছাসেবীদের বরাবরই যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে আকর্ষণ করেছে, বিশেষতঃ সে যুদ্ধ যদি খ্রীস্টানদের বা বিধর্মীদের বিরুদ্ধে হয়। এসব স্বেচ্ছা সেবক সীমান্তবর্তী দূর্গ বা ‘রিবাত’ নামক সুরক্ষিত স্থানে বাস করত এবং এরা পরিচিত ছিল ‘গাজী’ বা ‘মুজাহিদ’, নামে যার কাছাকাছি ইংরেজী প্রতিশব্দ হওয়া উচিত ‘অশ্বরোহী সীমান্ত সেনা’। সম্ভবতঃ এই অতীত ঐতিহ্য একমাত্র আন্দালুসিয়াতেই যথাযথভাবে বজায় ছিল। অন্যান্য স্থানে জেহাদ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। একদিকে মুসলিম সাম্রাজ্যের দুর্ধর্ষ লোকেরা ঝুঁকে পড়ল যুদ্ধবিশ্রহের দিকে এবং গাজীরা দ্রুত গ্রহণ করতে লাগল তস্করবৃত্তি যার ফলে বিধর্মীদের চেয়ে মুসলিম শাসকদেরই অধিক বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল এসব গাজী।
অপর দিকে ইসলামের আধ্যাত্মিকতা ও কৃস্ট্র সাধনার সঙ্গেও ইহা যুক্ত ছিল। প্রথম দিকে নরকবাসের ভীতিই মুসলমানদের কৃস্ট্র সাধনায় নিয়োজিত করতঃ জেহাদ স্বর্গলাভের একমাত্র নিশ্চিত উপায় ভেবে ইসলামের অধিকাংশ কৃচ্ছু সাধকই সীমান্ত যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ করত। পরবর্তীকালে জেহাদের ব্যাখ্যা করা হয়েছে পার্থিব লালসার বিরুদ্ধে যুদ্ধরূপে এবং সূফীরা (অধ্যাত্মবাদীদের আধুনিক নাম) ধর্মীয় যুদ্ধ থেকে নিজেদের বিরত রাখলেও তারা পূর্বের নামেই পরিচিত হতে থাকেন। এ সময় বিবাতগুলি পরিণত হয়েছিল ভজনালয় বা মঠে যেখানে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা একত্র বসবাস করতেন। কালক্রমে এসব পুরাতন দলই বিশেষ একটি যাজকশ্রেণীতে পরিণত হন। এঁদের সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা বাদ দিয়ে আমরা চতুর্দশ শতাব্দীর সূফী বা দরবেশদের কার্যক্রমের প্রতি মনোযোগ দিতে পারি।
এ সময়ে অধ্যাত্মবাদীরা সাধারণতঃ বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বা জমাতে বিভক্ত হয়ে কোন প্রসিদ্ধ শেখের নামে পরিচিত হতে থাকে, তখন শেখকেই গণ্য করা হয় তরিকা, বা বিধানের প্রতিষ্ঠাতা রূপে। ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী বা জমাতের জিকিরও ছিল ভিন্ন, এক জমাত থেকে অপর জমাতকে চিন্বার উপায়ই ছিল তাদের জিকির। প্রতিষ্ঠাতার ধর্মশালাকে বেষ্টন করে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিক্ষালয় গড়ে উঠে কারণ এ জমাতের। শিষ্যরা তখন সারা মুসলিম জগতে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিষ্ঠাতার বংশধর বা উত্তরাধিকারীকে (ইসলামে চিরকৌমার্যের কোন বিধান নেই) নিজেদের দলপতি মনে করে। ব্যক্তি-কেন্দ্রিক বা একক কৃ সাধন মুসলিম জগৎ থেকে এখনও নিমূল হয়নি। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা ও সাউথ লেবাননে এমন এক শ্রেণীর সংসারত্যাগী লোক দেখতে পাওয়া যায় যারা দরবেশ না হলেও নিজেদের সূফী সাধকের বংশধর বলে দাবী করে। তাদের চেয়েও অবাধে ধর্মশালার বাইরে বিচরণ করে শতচ্ছিন্ন খিরকা পরিহিত দণ্ডধারী এক শ্রেণীর দরবেশ বা ফকির। তারা অন্নসংস্থানের জন্য খোদার উপর এবং ইমানদার লোকদের উপর নির্ভর করে থাকে। তারা ধার্মিক ভিক্ষুক না-হয়েও এসব পেশাদার দরবেশের চেয়ে বেশি ধৃষ্ঠতা প্রকাশ করে।
সূফী মতবাদের মূল আদর্শ হচ্ছে মানবসমাজকে পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের প্রভাবমুক্ত করে। ঐশ্বরিক চিন্তায় নিয়োজিত করা এবং খোদার সাহচর্যলাভে তাদের সাহায্য করা। প্রার্থনা, ধ্যান, উপবাস ও কৃন্তু সাধনায় তারা অহোরাত্র কাটাত। কিছু দিন পর-পর ধর্ম শালার অধিবাসীরা বা তরিকার সভ্যরা একত্র মিলিত হয়ে নিজেদের রীতি অনুযায়ী জিকির করত। তারা অনেক সময় মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ত এবং ক্ষণিকের জন্য খোদার সহিত পুনর্মিলনের আনন্দ উপভোগ করত। ইবনে বতুতার বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায়, প্রাচ্য জীবনাদর্শের ধারা অনুযায়ী এসব জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান এক অবাস্তব ও ঐন্দ্রজালিক কৌশল-প্রদর্শনীতে পর্যবসিত হত। কেহ-কেহ একই স্থানে দাঁড়িয়ে একাদিক্রমে ঘন্টার পর ঘন্টা তাণ্ডব নৃত্য করত, কেউ বা সর্প ও কাঁচ-চর্বণ করত; আগুনের উপর হাঁটত অথবা নিজের কোন অঙ্গ দুরকাবিদ্ধ করত এবং তার ফলে সাময়িক ক্লান্তিবোধ ছাড়া আর কোন অসুবিধার লক্ষণ দেখা যেত না।
আধুনিক পর্যটকদের মধ্যে যারা হজরত ইমাম হোসেনের মৃত্যুকে উপলক্ষ করে। শিয়া সম্প্রদায়ের শোক-কান্নার দৃশ্য দেখেছেন অথবা পরলোকগত লর্ড কার্জনের মত উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার দরবেশ সম্মেলন দেখেছেন, তাঁরা এ অস্বাভাবিক আত্মপীড়ন এবং তা সত্ত্বেও শারীরিক কোন ক্ষত পরিলক্ষিত না হওয়ার বিষয় অবগত আছেন। ইবনে বতুতার ভ্রমণ-বিবরণের ইউরোপীয় ব্যাখ্যাকারীদের সবাই ইবনে বতুতার অতি বিশ্বাসপ্রবণতা ও প্রখ্যাত শেখ বা সাধুপুরুষদের অতি প্রাকৃত বা অলৌকিক কার্যকলাপের প্রতি অস্বাভাবিক আসক্তির বিষয় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইবনে বতুতার বিশ্বাসপ্রবণতা যে সীমাহীন ছিল না তার প্রমাণ রয়েছে তার বর্ণনার একাধিক স্থানে; অলৌকিক ব্যাপারের কাহিনী তিনি অন্যের কাছে শুনে বর্ণনা করেছেন। সে-সবের জন্য তাকে দায়ী করা যায় না। মুসলিম জনসাধারণ ফকির দরবেশদের কেরামতি বা অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে আগে যেমন বিশ্বাস করত এবং ঐসব অলৌকিক কার্যকলাপের। সঙ্গে নিজেকে জড়িত করছেন বা নিজেকে দেখেছেন বলে দাবী করেছেন সে সব স্থানে। তার বর্ণনার সত্যতার বিষয়ে অবশ্যই প্রশ্ন জাগে। কৈফিয়তস্বরূপ বলা যেতে পারে যে ঐসব ঘটনা হিপনোটিজম বা সম্মোহন বিদ্যার সাহায্যে ঘটেছিল। অনুরূপ একটি ঘটনার বিষয় মুসলিম ধর্মোপদেষ্টা উল্লেখ করছেন হ্যংটো শহরে একজন চীনা যাদুগীরের ভোজবিদ্যার কৌশল প্রদর্শন প্রসঙ্গে। অন্ততঃ ব্যাপারগুলিকে আমরা। যাদুগীরের হাতের কলাকৌশল বলেই মনে করতে পারি। কিন্তু তাতেই এ ব্যাপারের পরিসমাপ্তি ঘটে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা তার ভারত-ভ্রমণের সময় কোয়েল হতে। পলায়নের বিষয় এখানে উল্লেখ করতে পারি। আমরা এ অলৌকিক কার্যকলাপ পুরোপুরি বিশ্বাস করব নতুবা পর্যটককে অসত্য ভাষণের দোষে দোষী করব। উনবিংশ শতাব্দীর বাস্তববাদী ও যান্ত্রিক মানব মন সহজে কিছুই বিশ্বাস করতে চায় নি, কারণ তখনও ইবনে বতুতার ভ্রমণ-বিবরণকে তারা পুরোপুরি কল্পনাপ্রসূত বলতেও কসুর করেনি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পাঠকের মনে খোদা ও মানুষের শক্তির উপর বিশ্বাস প্রবলতর। সে তাই সমালোচনা করতে পারে কিন্তু অলৌকিক ক্রিয়াকলাপকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করতে পারে না। কঠোর শারীরিক মানসিক পরিশ্রমের দ্বারা একজন দরবেশ যে পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করে অসাধারণ মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব লাভ করতে পারে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অতিপ্রাকৃত এই মানসিক ক্ষমতার প্রথমাবস্থাকে বলা যায়– টেলিপ্যাথি (পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়া কোন অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বলে মানসিক যোগাযোগ)। সন্দেহপ্রবণ পাঠকের জন্য প্রফেসার ডি. বি. ম্যাকডোনাল্ডের আসপেক্টস অব ইসলাম Aspects of Islam P. 170) গ্রন্থখানার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন ভূতপূর্ব দরবেশ খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষা নিবার পরেও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সে বিবরণই তিনি উক্ত গ্রন্থে বিবৃত করেছেন বিস্তৃতভাবে। এমতাবস্থায় আমাদের পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে রায় মূলতবী রাখা এবং ইবনে বতুতা সত্য বলে বিশ্বাস করে যা কিছু লিখে গেছেন তার কৃতিত্ব স্বীকার করা।