খ্রীস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে জনৈক ধর্ম-তত্তোপদেষ্টা কর্তৃক বর্ণিত নিম্নলিখিত উপখ্যানটি প্রণিধানযোগ্য। বিভিন্ন আরবী সাহিত্যে আমরা প্রভু-ভার্যা দাস সম্পর্কের যে। পরিচয় পাই তার নির্ভুল প্রতিফলন দেখা যাবে এ উপাখ্যানে।
উপাখ্যানটি হল : একদা আমি দেখলাম একটি বালক দাসকে নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে। নিলামে ডাক উঠল মাত্র ত্রিশ দিনার। অথচ এ বালকটির ন্যায্য মূল্য হওয়া উচিত ছিল তিনশ’ দিনার। সুতরাং আমি বালকটিকে খরিদ করে নিয়ে এলাম। সে সময়ে আমি একটি গৃহনির্মাণ করছিলাম। একদিন শ্রমিকদের দেবার জন্য বালককে আমি বিশটি দিনার দিলাম। সে বিশ দিনারে দশটি দিনার দিয়ে নিজের জন্য একটি জামা কিনে নিয়ে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ তোমার কেমন কাজ। তাতে সে বলে উঠল, ‘হঠকারিতা করবেন না। কোন ভদ্রলোক কখনো তার ক্রীতদাসদের গালাগাল করে না।’
তখন আমি মনে-মনে বললাম, ‘আমি নিজের অজান্তে, আজ স্বয়ং খলিফার একজন শিক্ষককে কিনে এনেছি।’ পরে আমার প্রথমা স্ত্রীকে (সে ছিল আমার জ্ঞাতি বোন) না জানিয়ে একজন স্ত্রীলোককে বিয়ে করব স্থির করলাম। এ ব্যাপারে গোপনতা রক্ষা করতে বালকটিকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করলাম এবং তাকে কিছু ‘হাজিবা’ নামক মাছ ও অন্যান্য জিনিস কিনে আনতে একটি দিনার দিলাম । কিন্তু সে তা না কিনে অন্যান্য জিনিস কিনে নিয়ে এল। তখন তার উপর রাগান্বিত হওয়ায় সে বলল, আমি দেখলাম হিপোক্রেটিস হাজিবা মাছ পছন্দ করে না।
আমি বললাম, তুই একটা অপদার্থ মুখ। আমি বুঝতে পারিনি যে আমি একটা ‘গ্যালেন, (galen) কিনে নিয়ে যাচ্ছি।’ এই বলে তাকে চাবুক দিয়ে দশটি ঘা দিলাম। কিন্তু সে আমাকে ধরে চাবুকের সাতটি ঘা মেরে বলে উঠল, হুজুর শান্তির জন্য তিন ঘা মারাই যথেষ্ট। কাজেই সাত ঘা মেরে আমি প্রতিশোধ নিলাম।
এ-কথা শুনে আমি তার দিকে ছুটে গিয়ে মাথায় আঘাত করতেই মাথা জখম হয়ে গেল। তাতে সে আমার প্রথমা স্ত্রীকে গিয়ে বলল, সততা রক্ষা করা আমাদের একটি ধর্মীয় কর্তব্য। যে সত্যের অপলাপ করে সে অধার্মিক। আমার মনিব পুনরায় একটি বিয়ে করেছেন এবং আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছেন সে কথা গোপন রাখতে। কিন্তু আমি যখন বলেছি যে, আমাদের বিবি সাহেবাকে একথা নিশ্চয়ই জানাতে হবে তখন তিনি মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন।
অতঃপর যে পর্যন্ত না আমি সেই স্ত্রীলোকটিকে তালাক দিই সে পর্যন্ত আমার স্ত্রী আমাকে ঘরেও ঢুকতে দেয়নি এবং ঘরের কোন জিনিস বের করতেও দেয়নি। তারপর থেকে আমার স্ত্রী তাকে বলত, ছেলেটি সৎ। অথচ আমি তাকে কিছুই বলতে পারতাম না। সুতরাং আমি মনে-মনে বললাম, ছেলেটাকে আজাদ না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।
ইসলামী ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তার ধর্মীয় সংস্থার । ধর্মীয় সংস্থা দুটি এবং তা কিছুটা পরস্পর বিরোধী। ইসলামের ধর্মীয় বিধানে কোন পুরোহিতের স্থান নেই, ফলে পৌরহিত্যের শাসনও নেই, ইসলামে সংস্থার বা কোন গুপ্ত রহস্যের প্রতীকও নেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সকল মুসলমানেরই সমান অধিকার। সমাজের সম-অধিকার নেই এমন কোন প্রাধান্য কেউ দাবী করতে পারে না। বাস্তবক্ষেত্রে এরূপ সমতা রক্ষা করে চলা অবশ্য অনেক সময় অসম্ভব ছিল। যে সমাজ ধর্মীয় ব্যবস্থা, যাজক বিধান রচনাকারী বিচারক প্রভৃতি অংশে বিভক্ত সে সমাজের কোন একটি অংশ অপর অপেক্ষাকৃত অজ্ঞ অংশের উপর অপরিহার্যরূপেই কিছু-না কিছু নৈতিক প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিস্তার করে। বাহ্যত কোন প্রকার আইনগত সমর্থন না থাকায় একে অত্যাচার বা স্বেচ্ছাচারিতাও বলা চলে। শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস পালনের ফলেই একটি ধর্মীয় অভিজাত শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছিল। ইসলাম ধর্মের এই বিশেষ শ্রেণী অবশ্য খ্রীস্টান ধর্মীয় যাজকশ্রেণী হতে পৃথক ছিল। কারণ, ইসলাম ধর্মে কোন নির্দিষ্ট বা লিখিত শ্রেণীবিভাগ ছিল না অথবা আধ্যাত্মিক ব্যাপারে কোন বিশেষ সুবিধা বা একাধিপত্য ছিল না। এ ছাড়া ইসলাম একটি সার্বজনীন ধর্ম। উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে ইসলামের দ্বার সকল মানুষের জন্যই উম্মুক্ত। অপরপক্ষে দেখা যায়, ইসলামের ধর্মীয় ব্যবস্থার গুণাগুণ অনেকাংশে খ্রস্টীয় পৌরহিত্যের সমতুল্য। একথা সত্য যে, ইসলাম ধর্মোপদেষ্টাগণ খ্রীস্টীয় যাজকগণের ন্যায় রাজ্য শাসনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন না এবং একটি বিশেষ স্বকীয় মতবাদকেই তারা পছন্দ করতেন কিন্তু তাদের এ মনোভাব পরবর্তীকালে গীর্জা ও প্রশাসনিক উভয় ব্যবস্থার জন্যই ধ্বংস ডেকে এনেছিল । রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব বলতে কিছুই ছিল না। ধর্মবিশ্বাস কায়েম রাখবার দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল সমগ্র সমাজের উপর। ধর্মোপদেষ্টারা সমাজেরই একটি অঙ্গ বলে তারা নিজেদের প্রকৃত গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করলেন। তারা দেখলেন যে জনমত গঠনের জন্য নিজেদের প্রভাব তারা সহজেই কাজে লাগাতে পারেন এবং জনমত গঠিত হলে হাতিয়ার স্বরূপ তা ব্যবহার করতে পারেন আইন ভঙ্গকারী ও স্বেচ্ছাচারীদের বিরুদ্ধে। কারণ, প্রবল। পরাক্রমশালী কোন শাসকও যে কদাচিৎ জনমতের বিরোধিতা করতে সাহস করেন তার প্রমাণ আমরা পাই ইবনে বতুতা বর্ণিত কতিপয় কাহিনীতে। পক্ষান্তরে দিল্লীর ম্রাট সুলতান মোহাম্মদের দৃষ্টান্তই যথেষ্ট যে তিনি একদিকে ধর্মতত্ত্বজ্ঞদের সন্তুষ্ট রাখতে সচেষ্ট থাকতেন কিন্তু অপর দিকে যা করতেন তার কৈফিয়ত তলবের সাহস কারও ছিল না।