কিন্তু ‘ইসলাম’ অর্থে কতিপয় ধর্মবিশ্বাসের স্বীকৃতি ছাড়াও অনেক বেশি কিছু বুঝায়। ধর্মীয় নির্দেশানুযায়ী আরোপিত কতকগুলি কর্তব্য নিয়মিতভাবে পালন না-করা পর্যন্ত কেউ প্রকৃত মুসলমান বলে পরিগণিত হতে পারে না। ধর্মবিশ্বাসের প্রধান স্তম্ভ চারটি; (১) দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়া বা উপাসনা করা; প্রত্যেকবার নামাজের। সময় কিবলা অর্থাৎ কাবার দিকে মুখ করে নির্ধারিত সংখ্যক একই ধরনের শারীরিক প্রক্রিয়াসহ কোরআনের শ্লোক বা সুরা আবৃত্তি করতে হয়। নির্ধারিত সময়ে জমাতে অথবা একা নামাজ আদায় করবার নিয়ম; ঠিক সূর্য উদয়ের পূর্বে; দ্বিপ্রহরের পর; বিকালের মাঝামাঝি সময়ে; সূর্যাস্তের ঠিক পরে এবং রাত্রির দু’ বা তিন ঘন্টা অতিবাহিত হবার পরে। জামাতের নামাজ সাধারণতঃ পড়া হয় মসজিদে। এ নামাজের। পেশ-ইমাম মোতাদিদের মধ্যে যে কেউ হতে পারে। মসজিদে কোন মূর্তি বা তসবির রাখা হয় না। এক আল্লার নিষ্ঠাবান উপসনাকারীদের চিত্তবিভ্রম ঘটাতে পারে এমন কিছুই মসজিদে রাখা হয় না। খুব বেশি কিছু থাকলে মসজিদের দেওয়ালে জ্যামিতিক নকশা দ্বারা এভাবে অলঙ্কৃত থাকতে পারে যাতে বাহ্যদৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে আধ্যাত্মিক অনুভূতি গভীরতর হয়। সাপ্তাহিক প্রধান জামাত শুক্রবার মধ্যাহ্নে জুমা মসজিদ গুলিতে আনুষ্ঠানিক সাধারণ নামাজ ব্যতীত মিম্বর বা বেদীর উপর দাঁড়িয়ে পেশ-ইমাম সাপ্তাহিক খোত্বা পাঠ করেন। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ক্ষমতায় আসীন বাদশাহ বা শাসকের জন্য মঙ্গল কামনান্তে উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে ধর্মীয় উপদেশ প্রদান করা হয়। পবিত্র রজমান মাসের পরদিন এবং জিলহজ্ব মাসের ১০ই তারিখে দুটি প্রধান উৎসবের দিনেও অনুরূপ খোত্বা পাঠ হয়ে থাকে। প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজের পূর্বে প্রার্থনাকারী বা নামাজীকে মসজিদের কুয়ার পানিতে মুখ, হাত ও পা ধুয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পবিত্র হতে হয়। (২) সমগ্র সম্পত্তির মূল্যের উপর হিসাব করে শতকরা আড়াই টাকা জাকাত দিতে হয়। (৩) রজমান মাসে বাৎসরিক রোজা বা উপবাব্রত উদযাপন করা অর্থাৎ রমজানমাসের সম্পূর্ণ চন্দ্র মাস ধরে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি আহার, পান ও ধূমপানে বিরত থাকা। (৪) বয়স্ক ও সঙ্গতিপন্ন লোকদের জন্য জীবনে অন্ততঃ একবার মক্কায় হজ্জব্রত পালনের জন্য গমন করা।
ধর্মীয় অনুশাসন ও অনুষ্ঠান ছাড়াও ইসলামের কোরআন ও হাদিস অর্থাৎ হজরত মোহাম্মদের বাণী ও কার্যের উপর ভিত্তি করে একটি আইন ও সমাজ-ব্যবস্থা বর্তমান রয়েছে। হিজরীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে মুসলিম আইন বিশারদ পণ্ডিতদের চারটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এই মুসলিম আইনের ব্যাখ্যা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলি কেবল ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বিষয়ের ব্যাখ্যায় ভিন্ন-ভিন্ন মত পোষণ করে কিন্তু নিষ্ঠার দিক দিয়ে সবগুলিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম বিচারপতি বা কাজী আইনের কাজ পরিচালনা করতেন এবং প্রাচ্যের প্রধান নগরগুলিতে প্রত্যেক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য একজন করে প্রধান কাজী থাকতেন। কার্যতঃ ফৌজদারী মামলাগুলির বিচারকার্য প্রায়ই সুলতান স্বয়ং কিংবা তার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দ্বারাই সম্পন্ন হত এবং কোন-কোন সময়ে উক্ত কার্যাদি কাজীর অনুমোদনক্রমে আইনসিদ্ধ করে নেওয়া হত। ইউরোপীয় সমাজ-ব্যবস্থা হতে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মূল পার্থক্য হল বিবাহ এবং বিচ্ছেদ বা তালাকের ক্ষেত্রে। সকলেই। জানে যে একজন মুসলিম একই সময়ে একই সঙ্গে চারিটি স্ত্রী এবং সে সঙ্গে খরিদা বাদীও রাখতে পারে এবং আইনের কতকগুলি সাধারণ রক্ষাকবজের শর্তাধীনের স্ত্রীদিগকে ইচ্ছানুযায়ী তালাক দিতে পারে এবং খরিদা বাদীদের ভেতর যাদের কোন পুত্র সন্তান হয়নি তাদের বিলি-ব্যবস্থা করে দিতে পারে। ভ্রাম্যমাণ জীবনের পক্ষে এরূপ ব্যবস্থা বিশেষ উপযোগী ছিল এবং ইবনে বতুতা তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছেন। একজন খ্রীস্টান পাদ্রী তো দূরের কথা একজন ইউরোপীয় যা করতে অক্ষম ইবনে বতুতা তা সম্ভব করেছেন। সহজ ও সাবলীল ভাষায় তিনি সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু তাই নয়- যেহেতু তার আলোচনার বিষয়বস্তু নৈতিক জীবনের বাইরে অবস্থিত সেহেতু তিনি এগুলিকে দৈনন্দিন জীবনের পানাহারের সমপর্যায়ভুক্ত বিষয় হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এজন্যই তার এসব বর্ণনা এত সুন্দর ও স্বাভাবিক। এছাড়াও অনেক সময় ইবনে বতুতা তাঁর ভার্যাগণকে কেন্দ্র করে অনেক উক্তি করেছেন কিন্তু সে সব উক্তি উপলক্ষ্য করে কারও পক্ষেই সহসা কোন অসংলগ্ন মন্তব্য করা সঙ্গত হবে না। সাধারণতঃ একজন মুসলমানের পক্ষে সামাজিক কথাবার্তা বা আচরণের মধ্যে নারীজাতির উল্লেখ করা নীতিবিগর্হিত, কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে ইবনে বতুতা এ নিয়ম ভঙ্গ করেছেন। তবে স্মরণ রাখতে হবে যে, তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট ব্যাপারকে যথার্থ ব্যাখ্যা করবার জন্যই এই চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করেছেন।
মুসলিম সামাজিক কাঠামোর দ্বিতীয় দিক হচ্ছে তার দাসপ্রথা। অবশ্য একথা আমাদের ভুললে চলবে না সে একজন দাস সাধারণতঃ তার প্রভুর ভৃত্য অথবা বিশেষ। অনুচর মাত্র ছিল। সেদিক থেকে বিচার করলে কোন অবস্থায়ই দাসপ্রথা মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ছিল না। কাজেই মুসলিম সমাজব্যবস্থায় প্রভু-দাস সম্পর্ক রোমী জমিদার বা আমেরিকান ঔপনিবেশিকদের দাস ব্যবসার চেয়ে অনেক মানবিক ও পারস্পরিক লেনদেনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কাজেই মুসলিম সমাজে দাসপ্রথা খুব বেশি নিন্দনীয় ছিল না। মুসলিম সমাজের সমতুল্য দাসপ্রথা তঙ্কালীন কোন সমাজেই বিদ্যমান ছিল না। এমন কি শ্বেতকায় দাসগণ একটি বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত গোষ্ঠিতে পরিগণিত হয়েছিল এবং তাদের মধ্য হতেই উচ্চ-ক্ষমতাবিশিষ্ট রাজকর্মচারী সেনানায়ক শাসনকর্তা এমন কি সুলতান পর্যন্ত নিয়োজিত হতেন।