মরক্কোর মারিনিদ (Marindi) রাজবংশ ছিল অধিকতর সমৃদ্ধিশালী ভূখণ্ডের অধিকারী। তা সত্ত্বেও তাদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। তাদের ইতিহাস খুন জখমের রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস। শাসকবর্গের খুব কম সংখ্যকই তাদের উচ্চাভিলাষী। আত্মীয়গণের বিদ্রোহ ও চক্রান্তের হাত থেকে রেহাই পেতে সমর্থ হতেন। যারা রেহাই পেতেন তাঁরাও নিজেদের অবসর সময় কাটাতেন প্রতিবেশী রাজ্যের অথবা স্পেনের খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করে। এ রাজবংশ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে আবুল হাসানের (১৩৩১-৪৮) ও তৎপুত্র আবু ইনানের (১৩৪৮-৫৮) অধীনে। তাদের নাম ইবনে বতুতার সফরনামার শেষাংশে বারবার উল্লিখিত হতে দেখা যায়। আবুল হাসান সিজিল মাসা ও লেমসেন অধিকার করতে সমর্থ হন এবং ১৩৪০ খ্রস্টাব্দে তারিফায় এক রক্তাক্ত যুদ্ধে স্পেনবাসীদের দ্বারা পরাজিত হবার পরেও ১৩৪৭ খ্রীস্টাব্দে তিউনিসে প্রদেশটি স্বরাজ্যভুক্ত করেন। কিন্তু অল্পকাল পরেই তিনি তিউনিস ও তার সিংহাসন–উভয়ই হারাতে বাধ্য হন নিজের বিদ্রোহী পুত্র আবু ইরানের হস্তে। ১৩৫৭ খ্রীস্টাব্দে লেমসেন ও তিউনিস পুনরাধিকারের পর আবু ইনান তার সৈন্যবাহিনী কর্তৃক পরিত্যক্ত হন এবং ফেজে প্রত্যাবর্তনের পর নিহত হন। তার ফলে রাজ্যটি এক ভয়াবহ অরাজকতার শিকার হয়ে পড়ে। তা হলেও উক্ত দুই ব্যক্তির রাজত্বকালে মরক্কো বিশেষ সমৃদ্ধিলাভ করে, তার নগরগুলি বহু সরকারী সৌধমালায় শোভিত হয়। তখনকার দিনে সে সৌধমালা মিসর ও ভারতের স্মৃতিসৌধাবলীর প্রায় সমকক্ষ ছিল বললেই চলে। কাজেই আবু ইমানের শাসনকাল সম্পর্কে ইবনে বতুতা যে প্রশংসা করেছেন তার সমর্থন এখানে পাওয়া যায়। বিশেষ করে তিনি তখনকার প্রাচ্য যে অরাজক অবস্থা দেখে এসেছেন তার সঙ্গে তুলনা কালে ইবনে বতুতার বিবরণীর সত্যতা সহজে প্রমাণিত হয়।
.
ধর্মীয় পটভূমি
সাধারণতঃ মুসলিম জগতের কাছে রাজনৈতিক ব্যাপার একেবারে নিরর্থক না হলেও গুরুত্বের দিক দিয়ে অধিঞ্চিকর। মধ্যযুগের মুসলিম সমাজ ছিল সর্বাগ্নে একটি ধর্মীয় সমাজ। এ সমাজের অস্তিত্বই ছিল ধর্মের উপর, কারণ ইসলাম ধর্মই ছিল মুসলিম সমাজের একতার একমাত্র বন্ধন। ধর্মের নিকট থেকেই ঐ সমাজ পেয়েছিল তার ভাবের আদান-প্রদানের জন্য সাধারণ ভাষা, কারণ ইসলাম আরবী ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তরিত হওয়ার ব্যাপারে সব সময় বাধা দান করত। মুসলিম সমাজ পারসিক ও তুর্কীদের বাধ্য করেছিল আরবী শিখতে। সাহিত্যের উত্তরাধিকারের জন্যও তারা ধর্মের কাছেই ঋণী, কারণ একমাত্র কবিতা ছাড়া সাহিত্যের অন্যান্য বিষয় অধ্যয়নের প্রেরণা তারা ধর্মের মধ্যেই পেয়েছে। সমগ্র সামাজিক কাঠামো এবং আইন-কানুনগুলি ছিল ধর্মভিত্তিক। অন্ততঃ সভ্য দেশগুলি থেকে পুরাতন সমাজ-ব্যবস্থা এবং সামাজিক অসমতা মুছে ফেলে ইসলাম এক নতুন আইন-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ধর্মের কাছেই মুসলিম সমাজ পেয়েছে একত্ববোধের ধারণা, কারণ ইসলাম প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসীর অন্তরে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ববোধের অপূর্ব অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল। বস্তুতঃ ধর্ম শুধু মুসলিম সমাজের কৃষ্টিগত পটভূমি ও মনস্তাত্ত্বিক গঠনই সৃষ্টি করেনি বরং স্বসমাজের সভ্যদের জন্য একটা জীবনদেহ দান করেছে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অতি সাধারণ কর্মতৎপরতাগুলিও নিয়ন্ত্রিত করেছে।
ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করে সমগ্র আরবী সাহিত্য এ সকল সামাজিক অবস্থা প্রতিফলিত করে এবং ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে যে বিশেষ উৎসাহ দেখানো হয়েছে তা আধুনিক পাঠকদের ধৈর্য ও জ্ঞানের উপরে চাপ দেয়। ইবনে বতুতার গ্রন্থ সম্পর্কে একথা বিশেষ উৎসাহ দেখানো হয়েছে তা আধুনিক পাঠকদের ধৈর্য ও জ্ঞানের উপরে চাপ দেয়। ইবনে বতুতার গ্রন্থ সম্পর্কে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কারণ, সে গ্রন্থের কোন ব্যাখ্যাই ধর্মীল্প বিষয়ের উল্লেখ বাদ দিতে পারে না। এ কারণে ইসলামের অনুষ্ঠানাদি এবং মুসলিম ভূখণ্ডের উপর গঠিত প্রতিষ্ঠানাদি সম্বন্ধে একটা বিবরণ দিলে ইংরেজ পর্যটকদের পথ কিছুটা আলোকিত হতে পারে।
ইসলাম যে সব নীতিতে বিশ্বাসী তার কোন ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। মূল বিশ্বাসের ভিত্তি হল : আল্লাহ এক; তিনি মহাশূণ্য ও পৃথিবীর স্রষ্টা; একমাত্র উপাস্য; তাঁর সমৃদ্ধ সৃষ্টির তিনিই একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভূ, যিনি তাদের সকলের জীবন নিয়ন্ত্রিত করেন তার অসীম প্রেম ও জ্ঞানের দ্বারা। শেষ বিচারের দিনে তিনিই বিচার করবেন। তাঁর সৃষ্ট জীবনের পথনির্দেশের জন্য তিনি পর-পর সৃষ্টি করেছেন পয়গম্বর যার শুরু হজরত আদম থেকে হজরত নূহ, হজরত ইব্রাহিম, হজরত মূসা, হজরত দাউদ, হজরত সুলেমান, হজরত ঈসা ও বহুসংখ্যক অনামী পয়গম্বর সহ, হজরত মোহাম্মদের পর যার পরিসমাপ্তি। এসব পয়গম্বর যে ধর্ম প্রচার করে গেছেন, স্থান ও কাল ভেদে তার সামান্য রদবদল হলেও মূলতঃ তা এক এবং তাই ইসলাম অথবা আল্লার ইচ্ছার উপর পূর্ণ আত্মসমপর্ণ। এ ধর্ম আল্লাহ কর্তৃক ফেরেস্তার মাধ্যমে কয়েকজন পয়গম্বরের নিকট উদঘাটিত হয়। তাওরাত গ্রন্থ (পেন্টাটিক) প্রেরিত হয় হজরত মুসার নিকট; জব্দুর (সমান্) হজরত দাউদের নিকট; ইঞ্জিল (ইভাঞ্জেল-যা’ নিউ টেস্টামেন্টের গসপেলের অনুরূপ নয়) হজরত ঈসার নিকট এবং সর্বশেষে পবিত্র কোরআন আল্লার বাণীর চুড়ান্ত এবং ক্ৰটী-বিহীন আধার হিসাবে নাজেল হয় হজরত মোহাম্মদের উপর। এ সকল ঐশী বাণী পয়গম্বরদের নিকট সরাসরিভাবে প্রেরিত না-হয়ে প্রধান ফেরেস্তা জিবরাইলের। মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছে। মানুষ ও ফেরেস্তা ব্যতীত তৃতীয় এক শ্রেণীর জীব রয়েছে। তারা জী নামে পরিচিত। জীনের সৃষ্টি অগ্নি হতে, কাজেই মানুষের দেহের চেয়ে তাদের দেহের উপাদান সূক্ষ্ম এবং তারা অমানুষিক শক্তির অধিকারী কিন্তু মহা বিচারের দিনে তাদেরও হিসাব-নিকাশ দিতে হবে মানুষের মতই।