নাও, এক কাপ কফি খাও এলিয়ট। আহা, কড়া কালো কফিই খাও না-হয়। জানো না, ওটা স্নায়ুকে শক্তিশালী করে।
হ্যাঁ, ওই ছবিটাই, ওই ফোটোগ্রাফিটাই পিকম্যানের সঙ্গ ত্যাগ করার মূল হেতু। রিচার্ড আপটন পিকম্যান, আমার জ্ঞানত এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী। ওইরকম বিকৃতমনস্করাই জাগতিক জীবন ছেড়ে অকাল্ট আর উন্মাদের গহ্বরে ঝাঁপ দিতে পারে। রেইড ঠিকই বলেছিল, পিকম্যান কখনওই পুরোপুরি মানুষ নয়। হয় সে কোনও অন্ধকার ছায়াময় জগতের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, অথবা সে খুলতে পেরেছে সেই জগতে যাওয়ার দরজাটা। অবশ্য এখন আর তাতে কিছু যায়-আসে না। সে চলে গেছে। যে ভয়ানক অন্ধকার জগৎকে সে ভালোবাসত, তলিয়ে গেছে তারই গহ্বরে।
উঁহু, জানতে চেয়ো না, আমি কী পুড়িয়ে দিয়েছি। এ-ও জিজ্ঞেস কোরো না, ওই অতিকায় জীবগুলো আদতে কী ছিল, যেগুলোকে পিকম্যান শুধুমাত্র ইঁদুর বলে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিল। কিছু জিনিস রহস্য থাকাই ভালো। সেই প্রাচীন সালেমদের সময় থেকেই চলে আসছে এমন অনেক জিনিস। কটন মাথুরের গল্পেও তারা আছে। তুমি তো জানোই, পিকম্যানের ওই চিত্রগুলো কতটা জীবন্ত ছিল– আর আমরা সবাই অবাক হচ্ছিলাম যে, কোথা থেকে ওই পৈশাচিক মুখাকৃতি সে পেয়েছে।
আসলে, ওই ফোটোগ্রাফটা কোনও দৃশ্যপটের ছবি নয়। ওতে ছিল সেই নারকীয় জন্তুটা, যেটা আমি দেখেছিলাম মাটির নীচের ঘরে বিশাল ক্যানভাস জুড়ে। ওটা আসলে মডেলেরই ফোটোগ্রাফ। আঁকার সময় সে ব্যবহার করছিল। ওটার ব্যাকগ্রাউন্ডটা জাস্ট একটা ভাঁড়ারঘরের ইটের গাঁথনি, নিখুঁতভাবেই আঁকা। কিন্তু ফোটোগ্রাফটা আদতে ওই জীবটারই।
[প্রথম প্রকাশ: উইয়ার্ড টেলস পত্রিকায়, ১৯২৭ সালের অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয় লেখাটি। ভাষান্তর: অঙ্কিতা]
মূষিক আতঙ্ক
মূষিক আতঙ্ক (THE RATS IN THE WALLS)
[লাভক্র্যাফটের অন্যতম বিতর্কিত গল্প যেখানে কথক নিজের বংশ পরিচয় খুঁজতে গিয়ে প্রধান চরিত্রটি এক ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হয়। গল্পটিতে লাভক্র্যাফট নিউ ইংল্যান্ডের নানা রকম অতিকথার সঙ্গে বংশগতি ও সেই কারণজনিত বিকৃতির সম্পর্কে নিজের ধারণার কথা বলেছেন। মনে করা হয় গল্পের কথক ও তার বংশের জাতিবিদ্বেষ আসলে লাভক্র্যাফটের নিজের মনের কথাই বলে। গল্পটির বর্ণনা অত্যন্ত ভয়ংকর বলে লাভক্র্যাফটের নিজেরই দ্বিধা ছিল পাঠকেরা এটি পড়তে পারবে কি না।]
শেষ মিস্ত্রিটা কাজ খতম করে যে দিন বিদায় নিল, ১৯২৩ সালের সেই ১৬ জুলাই আমি এক্সাম প্রায়োরিতে পাকাপাকিভাবে প্রবেশ করলাম। পুরো অট্টালিকাই প্রায় নতুন করে সংস্কার করতে হয়েছিল। একটু শামুকের খোলার মতো ধ্বংসস্তূপ ছাড়া বাড়িটার বিশেষ কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। কাজটা কিন্তু বেশ ঝক্কির গেল ক-দিন। তবুও হাজার হোক, পূর্বপুরুষের ভিটে বলে কথা– তাই অর্থের ব্যাপারে কোনওরকম কার্পণ্য করিনি আমি। প্রথম জেমসের আমল থেকেই এই বাড়িতে কেউ বাস করে না। দীর্ঘকাল পরিত্যক্ত থাকার পেছনে নাকি এক রহস্যময় ঘটনা দায়ী, যার কোনওরকম যুক্তিসংগত ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না। শোনা যায়, এই বাড়ির ভূতপূর্ব মালিকের সঙ্গে এক রহস্যময় পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলস্বরূপ শুধু এই বাড়ির মালিকই নন, তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ে এবং সঙ্গে চাকরবাকরগুলো অবধি সেই ভয়ানক ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। একটু ভুল বললাম, একমাত্র তাঁর তৃতীয় সন্তানটিই সেই বীভৎস ঘটনার নাগপাশ কেটে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। ভাগ্যচক্রে তিনিই আমার পূর্বপুরুষ।
এই নারকীয় হত্যালীলার দায় খুব স্বাভাবিকভাবেই এই তৃতীয় সন্তানের ওপর বর্তায়। কিন্তু দুভার্গ্যক্রমে, তাঁর পক্ষে সাক্ষী দেবার মতোও কেউই বেঁচে ছিলেন না। পিতৃহত্যার দায় মাথায় নিয়ে তিনি তাঁর নিজের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন, এবং আইনানুসারে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তৎকালীন রাজাবাহাদুর বাজেয়াপ্ত করেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, এই ঘটনার বহু দিন পরেও ইনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার না কোনও উৎসাহ দেখিয়েছেন, না তাঁর হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছেন। উলটে সদা সর্বদাই চেষ্টা করে গেছেন কোনও এক ভয়ংকর স্মৃতিকে এবং এই অভিশপ্ত বসতবাড়িকে তাঁর মন এবং দৃষ্টিসীমানার বাইরে রাখতে। মনে হয়, আইনের চোখরাঙানির চেয়েও অজানা কোনও এক প্রচণ্ড আতঙ্কের প্রভাব তাঁর ওপর প্রবল ছিল।
এই ভদ্রলোকের পোশাকি নাম, ওয়াল্টার ডে লা পোর। ইনিই এককালে এক্সাম অঞ্চলের এগারোতম ব্যারন এবং আমার প্রপিতামহ। শুনেছি, ওই ঘটনার পর গোপনে ইনি ভার্জিনিয়াতে পালিয়ে আসেন এবং অতীত দুঃস্বপ্নকে পেছনে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মই পরের শতাব্দীতে ডেলপোর বংশ নামে পরিচিতি লাভ করে।
এক্সাম প্রায়োরি কিন্তু এই পুরোটা সময় খালিই পড়ে ছিল যদিও পরবর্তীকালে এটিকে নরিস পরিবারের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়। অট্টালিকাটির গঠনের মধ্যে বহু পুরাতন এক মিশ্র স্থাপত্যরীতি লক্ষ করা যায়। সে জন্য, কেউ বসবাস না করলেও অনেকদিন ধরে এটা রিসার্চের এবং তদুপরি অ্যাকাডেমিক আগ্রহের একটা বিষয়বস্তু ছিল। কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই বাড়ির গথিক ঘরানার বড় বড় উঁচু মিনার, বাড়ির নীচের দিকে স্যাক্সন বা রোমানিয়ান টাইপের গঠন, তার ওপর ড্রুইডিক এবং সিমরিক স্থাপত্যের মিশ্রণে তৈরি এর ভিত যেন একে মহাকালের স্রোতে অটুট দণ্ডায়মান এক সুপ্রাচীন ও স্থবির প্রস্তরখণ্ডের রূপ দিয়েছিল। প্রায়োরির নীচের অংশটি একভাবে সোজা উঠে গিয়ে মিশে গেছে কঠিন চুনাপাথরের তৈরি এক উঁচু বাঁধের সঙ্গে যার মাথায় উঠলে অদূরের অ্যানচেস্টার গ্রামটির তিন মাইল পশ্চিমে বিস্তৃত ভগ্ন উপত্যকাটি পুরোপুরি দেখা যায়। স্থপতি এবং প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুব আগ্রহের সঙ্গে শতাব্দীপ্রাচীন এই ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে দেখতে চাইবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু এখানকার মানুষজন কেন জানি না জায়গাটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেন না। একশো বছর আগে আমার পূর্বপুরুষরা যখন এখানে বাস করতেন, তখনও লোকজন এটিকে এড়িয়েই চলত। আর এখন তো শ্যাওলা আর অবহেলার অন্ধকার জায়গাটার ওপর একটা বিষাদ-ছায়ার মতো নেমে এসে আশপাশের লোকজনদের কাছে একে আরও ভীতিপ্রদ করে তুলেছে। তাই পারতপক্ষে কেউ এদিক বিশেষ মাড়ায় না। অ্যানচেস্টারে এসেছি একদিনও হয়নি, এরই মধ্যে জেনে গিয়েছিলাম যে, আমি এক অভিশপ্ত ইমারতের সন্নিকটে উপস্থিত হয়েছি। এসবের মাঝে, সপ্তাহের শুরুতেই মিস্ত্রি লাগিয়ে পুরোদমে এক্সাম প্রায়োরি সংস্কারের কাজ শুরু করে দিয়েছিলাম আর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম এই অট্টালিকার সঙ্গে জুড়ে-থাকা শতাব্দীপ্রাচীন প্রবাদের ভিত্তিকে সমূলে উচ্ছেদ করতে।