মনে হল, ওই নামকরা সংস্থার দোকানটায় একবার ঢু মারি। ভেবেছিলাম, ওরকম জায়গায় কাজ করার জন্য স্থানীয় কারও বদলে কোনও বহিরাগতের উপস্থিতিই স্বাভাবিক। গিয়ে দেখলাম, ধারণাটা ঠিক ছিল। একটা সতেরো-আঠেরো বছর বয়সি ছেলে ওই দোকানটা চালাচ্ছে। ছেলেটা হাসিখুশি। ও যে এখানে কথা বলার মতো কাউকে পায় না, সেটাও কিছুক্ষণের মধ্যে স্পষ্ট হল। ছেলেটার বাড়ি আর্কহ্যামে। ইন্সউইচ থেকে আসা একটা পরিবারের সঙ্গে এখানে থাকে ও। ওর বাড়ির লোক চায় না ও ইসমাউথে থাকে। কিন্তু চাকরির দায়ে একরকম বাধ্য হয়ে ওকে এই আঁশটে গন্ধ আর গোলমেলে লোকে ভরা শহরে থাকতে হচ্ছে!
বড়রাস্তা, যেখানে বাস থামে, সেটা ফেডেরেল স্ট্রিট। বলল ছেলেটা, তার পশ্চিমে বেশ কয়েকটা পুরোনো আমলের চওড়া রাস্তা আছে– ব্রড, ওয়াশিংটন, লাফায়েত, অ্যাডামস…। পূর্বদিকে, মানে নদীর তীর বরাবর রয়েছে ঘিঞ্জি বস্তি। ওখানে কয়েকটা পুরোনো চার্চ আছে বটে, তবে এখন পরিত্যক্ত। ওসব এলাকায় না-যাওয়াই ভালো।
কেন? আমি জানতে চাইলাম।
ওখানকার লোকজন একটু… ছেলেটা ইতস্তত করে বলল, বিপজ্জনক। বেশ কয়েকজন বাইরের লোক ওদিকে গিয়ে তো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে!
এরকম প্রবেশ নিষেধ এলাকা আর কটা আছে? একটু হতাশ হয়েই জানতে চাইলাম আমি। আসলে শহরটা দেখে যে অ-ভক্তি জন্মেছিল, সেটা ছেলেটার কথা শুনে বাড়ছিল বই কমছিল না।
মার্শ রিফাইনারি! স্পষ্টভাবে বলল ছেলেটা, আর যে চার্চগুলোয় এখনও কেউ যায়, সেগুলো, বিশেষ করে ডেগন দেবতার দল যেখানে উপাসনা করে, সেটা।
আচ্ছা… আমার মাথায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে যে প্রশ্নটা ঘুরঘুর করছিল, কিন্তু বেরোতে পারছিল না, সেটাই করে ফেললাম, এখানে চার্চে ঠিক কী হয়?।
জানি না। ছেলেটা এবারও স্পষ্টভাবে বলল, তবে ইন্সমাউথের বাইরের কোনও চার্চ এদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখে না। এগুলোতে এমন সব প্রথা আর পোশাক বা… মানে এই চার্চে উপাসনার নামে যা হয়, সেটা ঠিক ধর্মাচরণ নয়। আমি ওগুলোকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলি।
ব্যাপারটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল। তবে চার্চের এমন অদ্ভুত বিকৃতি কি এমনি এমনি হতে পারে? হয়তো লোকজনের চাপেই এমনটা হয়েছে। তাই আমার পরের প্রশ্নটা ছিল এখানকার লোকজনকে নিয়েই।
এখানকার লোকেদের ব্যাপারস্যাপার আমি বুঝি না। বিরক্তি, হতাশা আর কিছুটা ভয় ফুটে উঠল ছেলেটার গলায়, এদের দেখলেই প্রবল অস্বস্তি হয়। আর গলার আওয়াজ! আপনি থাকলে বুঝতেন, ওদের চার্চে যে দু-দিন বড় পরব, সেই ৩০ এপ্রিল আর ৩১ অক্টোবর ওই উকট গলার আওয়াজে তো প্রাণপাখি উড়ে পালাতে চায়।
অন্য সময় লোকগুলো কী করে?
মাঝেমধ্যে মাছ ধরে। বাকি সময় হয় বেআইনি মদ গিলে ঝিমোয়, নয় ছোট ছোট দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। ওদের ভাবসাব দেখে আমার মনে হয়, এই পৃথিবীতে থাকার বদলে ওরা যেন অন্য কোথাও যেতে পারলেই বাঁচে। সেটা কোথায়, বলতে পারব না। তবে এরা যা জল ভালোবাসে, তাতে সমুদ্রের তলায় থাকতে পারলেই বোধহয় লোকগুলো বেশি খুশি হত!
বুড়ো হলে অনেকেরই এরকম ভাবসাব হয়। আমি বলে ফেললাম।
বুড়ো? চোখ কপালে তুলল ছোকরা, কাদের আপনি বুড়ো বলছেন? যাদের রাস্তাঘাটে দেখা যায়, তারা হল সব কমবয়সি জনতা! বুড়োদের আপনি এখানে দেখতেই পাবেন না।
সে কী? এবার আমিও অবাক হলাম, কই, আমার হোটেলের ক্লার্কই তো বেশ বুড়ো।
আরে, আমি স্থানীয় লোকেদের কথা বলছিলাম! অধৈর্য কণ্ঠে বলে ছেলেটা, ইন্সমাউথের বাসিন্দাদের বয়স বাড়লে তাদের আর দেখতে পাওয়া যায় না। তাদের আয়ু কম, নাকি তারা দেখতে এতই খারাপ যে, সামনে আনাই যায় না, এ শুধু এখানকার লোকেরাই বলতে পারবে। খারাপ মানে কী বলছি, বুঝছেন তো? তাদের দেখলেই মনে হয়, এদের রক্তে অন্য কোনও জাতি… বা আরও খারাপ কিছু মিশে গেছে। আমি শুনেছি, সরকারি লোকজন এলে নাকি সেইসব লোককে লুকিয়ে রাখা হয়।
লুকিয়ে রাখা হয়! কোথায়?
সমুদ্রের তীর থেকে শহরের পুরোনো বাড়িগুলোর নীচে নাকি বহু সুড়ঙ্গ আছে। সেখানেই তেমন লোকেদের লুকিয়ে রাখা হয়। সবই শোনা কথা, তবে যেসব ভিনদেশির সঙ্গে মেলামেশার ফলে ইন্সমাউথের লোকেদের এই চেহারা হয়েছে, তারা নাকি এখনও ওই পথেই যাতায়াত করে।
বলো কী! একটা ভয়মিশ্রিত উত্তেজনা আমাকে পেয়ে বসছিল, আচ্ছা, এই শহরটার ইতিহাস-ভূগোল নয়, বরং এখন এখানে কী হয়, এটা জানতে গেলে কাকে ধরতে হবে?
কেউ মুখ খুলবে না। ঠোঁট বেঁকাল ছেলেটা, তবে এখানকার গরিবখানায় এক বুড়ো থাকে। জাডক অ্যালেন। লোকটা দাবি করে, ওর বয়স নাকি ছিয়ানব্বই বছর! হতেই পারে। জাড়কের মাথায় একটু গোলমাল আছে। ও এমনিতে চোরের মতো থাকে। মুখ খোলা তো দূরের কথা, বরং সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে, যেন কেউ ওকে ধরে ফেলবে। তবে একবার মদ গিললে ওর মুখও খুলে যায়। তখন ও যা বলে…!
কী বলে? আমি কৌতূহলী হলাম।
যা বলে, তার প্রায় সবটাই অবিশ্বাস্য, ভয়াল-ভয়ংকর সব গল্প। মাতাল বুড়োর কথা বলে সেগুলো উড়িয়ে দেওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু… ছেলেটা ইতস্তত করে আবার মুখ খুলল, এখানকার লোকেরা চায় না, বাইরের কেউ জাকের সঙ্গে কথা বলুক। ইন ফ্যাক্ট, ওর গল্প শুনতে গিয়ে লোকে বিপদে পড়েছে। সে জন্যই মনে হয়, ও যা বলে, তার সবটাই মাতালের খোয়ব নয়।