তিতিবিরক্ত হয়ে মন দিয়েছে নিরেট পরিবেশের দিকে। সবুজ গুঁড়োর কিছুটা তখনও ছিল শিশির মধ্যে, শিশি ছিল হাতের মুঠোয়। পকেটে রেখেছিল প্ল্যাটনার। আশপাশ হাতড়াতে গিয়ে মনে হয়েছিল যেন বসে রয়েছে মখমল কোমল শেওলা-ছাওয়া পাথরের ওপর। চারপাশের তমিস্রাময় জায়গাটার কিছুই চোখে পড়েনি–ক্লাসঘরের ক্ষীণ, কুয়াশাচ্ছন্ন ছবিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু গায়ে হিমেল হাওয়া লাগায় আন্দাজ করে নিয়েছিল, বসে রয়েছে সম্ভবত পাহাড়ের ওপর–পায়ের তলায় রয়েছে বহু দূর বিস্তৃত একটা উপত্যকা। আকাশপ্রান্তের সবুজ আভা ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে, বাড়ছে। তীব্রতা। উঠে দাঁড়িয়ে দুহাতে চোখ ডলেছিল প্ল্যাটনার।
কয়েক পা এগিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল ঢালু পাহাড়ে। উঠে বসেছিল এবড়োখেবড়ো একটা পাথরে। নির্নিমেষে চেয়ে ছিল সবুজ উষার দিকে। অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করেছিল, আশপাশের সেই বিচিত্র দুনিয়ায় শব্দ নেই কোত্থাও–নিস্তব্ধ আকাশ-বাতাস। হাওয়া বইছে নিচ থেকে, কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। অথচ কানে ভেসে আসছে না বাতাসে আন্দোলিত পত্রমর্মর, ঘাসের খসখসানি, ঝোপঝাড়ের দীর্ঘশ্বাস। বসে আছে পরিত্যক্ত পাথুরে অঞ্চলে–খাঁ খাঁ করছে চারদিক। অন্ধকারে দেখতে না পেলেও কানে কিছু না শোনার ফলে অন্তত মনে হয়েছে সেইরকম। তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে আকাশপ্রান্তের সবুজ আভা, সেই সঙ্গে একটু একটু করে একটা টকটকে রক্তলাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে কালো চাঁদোয়ার মতো আকাশে–কিন্তু সবুজ রঙের রঙ্গে লাল রং মিশে একাকার হয়ে যায়নি। সবুজ আর লালের দ্যুতিতে ছমছমে হয়ে উঠছিল পরিবেশ–ভয়ানক দ্যুতি একটু একটু করে স্পষ্টতর করে তুলছিল দশদিকের ধু ধু শূন্যতা। আমার মনে হয়, এই লালাভ ভাবটা চোখের ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। হলদেটে-সবুজ আকাশপ্রান্তে ক্ষণেকের জন্যে ঝটপট করে উঠেছিল কালোমতো একটা বস্তু। তারপরেই পায়ের তলায় ব্যাদিত শূন্যতার মধ্যে ধ্বনিত হয়েছিল খুব মিহি কিন্তু তীক্ষ্ণ একটা ঘণ্টার শব্দ। ক্রমবর্ধমান আলোর মধ্যে একটা অসহ্য প্রত্যাশার উৎকণ্ঠা সাপের মতোই পেঁচিয়ে ধরেছিল প্ল্যাটনারের সত্তাকে।
বোধহয় ঘণ্টাখানেক এইভাবে কাঠের পুতুলের মতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় বসে ছিল সে। সভয়ে দেখেছে, একটু একটু করে বেড়েই চলেছে অদ্ভুত সবুজ আলো, মন্থর গতিতে সর্পিল আঙুল মেলে ধরছে মাথার ওপরকার খ-বিন্দুর দিকে। আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এই জগতের অপচ্ছায়ার মতো দৃশ্য কোথাও একেবারেই অস্পষ্ট হয়ে এসেছে, কোথাও অস্পষ্টতর হয়েছে। পার্থিব সূর্যাস্তের দরুনই বোধহয় এরকম সহাবস্থান দেখা গেছে। অর্থাৎ এখানে যখন সূর্য ডুবছে, ওখানে তখন আলো ফুটছে। সবুজ আর লাল রঙের অমন আশ্চর্য খেলা তাই রোমাঞ্চিত করছে প্ল্যাটনারকে–পার্থিব এবং অপার্থিবের সন্ধিক্ষণে উপস্থিত থেকে শুধু শিহরিত হয়েছে–কার্যকারণ নির্ণয় করতে পারেনি। কয়েক পা নেমে এসেছিল প্ল্যাটনার ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে ওঠবার জন্যে। বিস্ময় আরও বেড়েছে–কমেনি। মনে হয়েছে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে নিচের তলার বড় ক্লাসঘরের শূন্যে বাতাসের মধ্যে। পায়ের তলায় সান্ধ্য ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত লিডগেট এবং ছাত্ররা। ইউক্লিডের জ্যামিতি থেকে টুকলিফাই করছে ছেলেরা। আস্তে আস্তে এ দৃশ্যও ফিকে হয়ে এসেছিল সবুজ উষা স্পষ্টতর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে।
প্ল্যাটনার তখন দৃষ্টিচালনা করেছিল নিচের উপত্যকার দিকে। দেখেছিল, সবুজ আলো পৌঁছেছে পাহাড়ের গা পর্যন্ত। খাদের নিবিড় আঁধার ভেঙে যাচ্ছে সূক্ষ্ম সবুজ আভায়– জোনাকির আলোয় যেভাবে অন্ধকার সরে সরে যায়–সেইভাবে। একই সঙ্গে দূরের পাহাড়ের ঢেউখেলানো আগ্নেয় শিলা স্পষ্ট হয়ে উঠছে সবুজ রং-মাখা আকাশ আরও ওপরে উঠে যাওয়ার ফলে। দৈত্যাকার শৈলশ্রেণি অন্ধকার ফুড়ে জাগ্রত হচ্ছে একে একে লাল, সবুজ, কালো ছায়ার চাদর মুড়ি দিয়ে। হাওয়ায় উঁচু জমির ওপর দিয়ে থিলডাউন কাঁটাগাছ ভেসে যাওয়ার মতো অদ্ভুত গোল বলের মতো রাশি রাশি বস্তু ভেসে যেতে দেখেছিল প্ল্যাটনার এই সময়ে। কাছে নয়–দূরে, খাদের ওপারে। পায়ের তলায় ঘন্টাধ্বনি অধীর হয়ে উঠেছে যেন ঠিক তখনই–মুহুর্মুহু টং-টং শব্দ ছড়িয়ে গেছে দিকে দিকে, এদিকে-সেদিকে দেখা গেছে কয়েকটা সঞ্চরমাণ আলো৷ ডেস্কে আসীন ছেলেগুলো আরও ফিকে হয়ে এসেছে–আবছা আকৃতি দেখতে হয়েছে অতিকষ্টে–চোখে না-পড়ার মতোই।
অন্য জগতের সবুজ সূর্য যখন উঠছে, আমাদের এই জগৎ তখন লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেখে, ধাঁধায় পড়েছিল প্ল্যাটনার। অন্য দুনিয়ার রাত্রে হাঁটাচলা কঠিন এই দুনিয়ার দৃশ্য সুস্পষ্ট থাকার ফলে। প্রহেলিকা সেইখানেই। এই দুনিয়া থেকে অন্য দুনিয়ার ছবি চোখে ধরা না-পড়ার কোনও ব্যাখ্যা প্ল্যাটনার আবিষ্কার করতে পারেনি। সেই জগৎ থেকে যদি এ জগৎ দেখা যায় ছায়ার মতো, এ জগৎ থেকে সেই জগৎ কেন দেখা যাবে না ছায়ার মতো? সম্ভবত সেই জগতের চাইতে এই জগতে আলোর তীব্রতা বেশি বলে–এখানকার সবকিছুই বেশি আলোক সমুজ্জ্বল বলে। প্ল্যাটনার দেখেছে, সেই জগতের ভরদুপুর এই জগতের মাঝরাতের জ্যোৎস্নার মতো। সেই জগতের মাঝরাত একেবারেই আঁধারে ঢাকা। নিবিড় অন্ধকারে ফিকে ফসফরাস-দ্যুতি যেমন দৃশ্যমান, মোটামুটি অন্ধকার ঘরে অন্য দুনিয়ার সবকিছুই তেমনি অদৃশ্য। ওর কাহিনি এবং ব্যাখ্যা শোনবার পর ফোটোগ্রাফারের ডার্করুমে রাতের অন্ধকারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি অন্য দুনিয়ার চেহারা দেখবার অভিপ্রায়ে। সবুজাভ চড়াই-উতরাই আর পাহাড় দেখেছি ঠিকই কিন্তু অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে। পাঠক-পাঠিকারা হয়তো আরও বেশি দেখতে পাবেন। সেই দুনিয়া থেকে ফিরে আসার পর স্বপ্নে নাকি সেখানকার অনেক জায়গা দেখে চিনতে পেরেছিল প্ল্যাটনার–কিন্তু সেটা স্মৃতির কারসাজিও হতে পারে। চারপাশের এই অদ্ভুত অন্য দুনিয়ার চকিত আভাস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের চোখে পড়ে যাওয়াটা খুব একটা অসম্ভব না-ও হতে পারে।