প্ল্যাটনার উপাখ্যানের এই গেল বাহ্যিক বর্ণনা। মি. লিডগেট তাকে চাকরি থেকে কীভাবে এবং কী অজুহাতে বরখাস্ত করেছিলেন, তার বিশদ বিবরণ নিষ্প্রয়োজন। অস্বাভাবিক কাণ্ডকারখানার তদন্ত সমিতির প্রতিবেদনে পাওয়া যাবে খুঁটিনাটি। প্রথম দু এক দিনে তার ডানদিক-বাঁদিক বদলাবদলির অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটাও তেমনভাবে কারও নজরে পড়েনি। প্রথম খটকা লেগেছিল ব্ল্যাকবোর্ডে ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখবার সময়ে। নতুন চাকরিতে সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে পারে, এই ভয়ে বিষয়টা প্রাণপণে চেপে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল প্ল্যাটনার। কয়েক মাস পরে ধরা পড়েছিল, তার হৃদযন্ত্রও চলে এসেছে বিপরীতদিকে। আরক প্রভাবে সংজ্ঞা লোপ করে দাঁত তোলবার সময়ে ধরা পড়ে এই অদ্ভুত ব্যাপার। প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও শল্যচিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা করে এবং সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছাপিয়ে দেয় শারীরস্থান পত্রিকায়। বস্তুভিত্তিক ঘটনাবলির পরিসমাপ্তি এইখানেই। এবার আসা যাক প্ল্যাটনার নিজে যে কাহিনি শুনিয়েছিল–তার বর্ণনায়।
তার আগে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। এই পর্যন্ত যা লেখা হল তা সাক্ষ্যপ্রমাণের জোরে আদালতগ্রাহ্য। কিন্তু এরপর যা লেখা হবে, তা প্ল্যাটনারের নিজের কথা। বিশ্বাস করা কঠিন। পাঠক-পাঠিকার মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া যাক। জড়জগতের বাইরে সূক্ষ্ম আত্মিক জগতে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে কারও বিশ্বাস উৎপাদন করার অভিপ্রায় আমার নেই। আমি শুধু লিখে যাব প্ল্যাটনার যা বলেছিল, তার প্রতিটি কথা। শোনবার পর কিন্তু মনে হতে পারে, প্ল্যাটনার এই নটা দিন ছিল স্থান-এর বাইরে– ভেতরে নয় এবং ফিরে এসেছে দর্পণ প্রতিবিম্বিত প্রতিচ্ছবির মতোই উলটো অবস্থায়।
বিস্ফোরণের ফলে মৃত্যু হয়েছে, এইটাই তার মনে হয়েছিল প্রথমে। দেহটা ছিটকে উঠেছে শূন্যে, যাচ্ছে প্রবলবেগে পেছনদিকে। ভেবেছিল, বুঝি সবেগে আছড়ে পড়বে ব্ল্যাকবোর্ডের ইজেল বা কেমিস্ট্রির কাবার্ডের ওপর। সংঘাতে তখনও মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। নাকে পোড়া চুলের গন্ধ আসছে। মনে হয়েছিল যেন লিডগেটের ধমকও কানে ভেসে আসছে। আসলে মাথার ঠিক ছিল না।
ক্লাসঘরের মধ্যেই রয়েছে প্ল্যাটনার, এই মনে হওয়াটা কিন্তু অত্যন্ত সুস্পষ্ট। টের পেয়েছে ছেলেদের হতভম্ব অবস্থা এবং লিডগেটের প্রবেশ। না, এ ব্যাপারে কোনও ধোঁয়াটে ভাব নেই প্ল্যাটনারের বর্ণনায়, কথাবার্তা, চেঁচামেচি কিন্তু এক্কেবারেই শুনতে পায়নি–নিশ্চয় আওয়াজের চোটে কানে তালা লেগে গিয়েছিল বলে। অদ্ভুত আবছা আর গাঢ় মনে হয়েছিল চারপাশ–বিস্ফোরণের ফলে নিশ্চয় তাল তাল ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছিল বলে। এসবই প্ল্যাটনারেরই অনুমান–ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা। অস্পষ্টতার মধ্যে ভৌতিক ছায়ার মতো নিঃশব্দে আবছাভাবে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছিল ছেলে পাঁচটা আর লিডগেট। প্ল্যাটনারের মুখের চামড়া ঝলসে গিয়েছিল বিস্ফোরণের ঝলকে–জ্বালা করছিল। মাথা ঘুরছিল। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল, নিশ্চয় চোখের বারোটা বেজে গেছে, কানেরও দফারফা হয়ে গেছে। হাত-পা-মুখও যেন বশে নেই। একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল অনুভূতি। অবাক হয়েছিল আশপাশে চেনা ডেস্ক আর স্কুলের আসবাবপত্র না দেখে। তার বদলে রয়েছে আবছা, অনিশ্চিত ধূসর কতকগুলো আকৃতি, তারপরেই আঁতকে উঠেছিল, বিষম চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল গলা চিরে। মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠেছিল অসাড় চৈতন্য। পিলে চমকানোর মতো ঘটনা! দুটি ছেলে নাকি হাত-মুখ নাড়তে নাড়তে সটান তাকে ছুঁড়ে হেঁটে চলে গিয়েছিল। বিন্দুমাত্র টের পায়নি প্ল্যাটনারের অস্তিত্ব–দেখেওনি। পরক্ষণেই তাল তাল কুয়াশা ঘিরে ধরেছিল তাকে। সেই মুহূর্তের মানসিক অবস্থা বাস্তবিকই অবর্ণনীয়–কালঘাম ছুটে গিয়েছিল বেচারির ঘটনাটা বলবার সময়ে। সে যে আর বেঁচে নেই, এ ধারণাটা মাথায় এসেছিল তখনই। তা-ই যদি হবে তো দেহটা এখনও সঙ্গে রয়েছে কেন? ভেবে কূল পায়নি প্ল্যাটনার, তাহলে কি মৃত্যুটা তার হয়নি, হয়েছে বাদবাকি সবাইয়ের স্কুল উড়ে গিয়েছে বিস্ফোরণে, সে ছাড়া অক্কা পেয়েছে। প্রত্যেকেই? তা-ই বা হয় কী করে! মহাধাঁধায় পড়েছিল প্ল্যাটনার।
অস্বাভাবিক আঁধারে আশপাশের দৃশ্য স্পষ্ট দেখতেও পায়নি। আবলুশ কাঠের মতো কালো আঁধারের মধ্যে দিয়ে মাথার ওপর দেখা যাচ্ছিল কালো চাঁদোয়া। আকাশের এক কোণে ফিকে সবুজ দ্যুতি। সবুজ প্রভায় দিগন্তে দেখা যাচ্ছে ঢেউখেলানো কালো পাহাড়। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ার পর মালুম হয়েছিল, একটা ক্ষীণ সবুজ রং রাতের কালো অমানিশার সঙ্গে বেশ পৃথকভাবেই যেন পরিব্যাপ্ত রয়েছে আকাশ-বাতাসে। সবুজ রং আর কালো রাতের এই বিচিত্র সমন্বয়ের পটভূমিকায় ফসফরাস দ্যুতিময় প্রেতচ্ছায়ার মতো ফুটে উঠেছে ক্লাসঘরের আসবাবপত্র, ছেলে পাঁচটা এবং প্রিন্সিপ্যাল, ঠিক যেন অতিসূক্ষ্ম ছবি–ছুঁয়ে অনুভব করা যায় না–এত মিহি।
এক হাত বাড়িয়ে ফায়ারপ্লেসের দেওয়াল ছুঁতে গিয়েছিল প্ল্যাটনার-হাত গলে গিয়েছিল দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে অনায়াসেই। অনেক চেষ্টা করেছিল দুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে ডেকেছিল লিডগেটকে। ছেলে পাঁচটা যতবার আশপাশ দিয়ে গিয়েছে, ক্যাঁক করে চেপে ধরার চেষ্টা করেছে। নিবৃত্ত হয়েছে মিসেস লিডগেট ঘরে ঢোকার পর। ভদ্রমহিলাকে দুচক্ষে দেখতে পারত না প্ল্যাটনার। আশ্চর্য, সেই সবুজাভ জগতের মধ্যে থেকেও সে যেন সেই জগতের কেউ নয়–যেন কোনও যোগাযোগই নেই সবুজ অথচ তমালকালো বিচিত্র ছায়ামায়ার সঙ্গে–অদ্ভুত সেই অনুভূতি অস্বাভাবিক অস্বস্তির সৃষ্টি করেছিল প্ল্যাটনারের অণু-পরমাণুতে। শিকার ধরার জন্য ওত পেতে বসে থাকা বেড়ালের মতো মনে হয়েছিল নিজেকে। চেনা অথচ অল্প পারিপার্শ্বিক জগতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে; একটা অদৃশ্য, অবোধ্য বাধা বাক্যালাপে বাধার সৃষ্টি করে গেছে।