এতক্ষণ পর্যন্ত গেল কাহিনির মামুলি বয়ান। এবার আসছে সবুজ গঁড়োর বৃত্তান্ত। কপাল খারাপ, সবুজ গুড়োটা পাওয়া গিয়েছিল কোত্থেকে–তা জানা যায়নি। শ্রীমান হুইল কষ্টেসৃষ্টে ইনিয়েবিনিয়ে শুনিয়েছিল একটা পেঁচালো কাহিনি। ডাউন্সের একটা পরিত্যক্ত চুনের ভাটিতে নাকি পেয়েছিল সবুজ গঁড়োর একটা মোড়ক। তখনই মোড়কটা দেশলাইয়ের কাঠি ধরিয়ে জ্বালিয়ে দিলে ল্যাটা চুকে যেত। প্ল্যাটনারের উপকার হত, হুইবলের বাড়ির লোকেরও উচিত শিক্ষা হত। কিন্তু মোড়কে করে সে সবুজ গুঁড়ো আনেনি স্কুলে–এনেছিল একটা আট আউন্স মাপের ওষুধের শিশিতে–মুখটা বন্ধ করেছিল চেবানো খবরের কাগজের ছিপি এঁটে। বৈকালিক বিদ্যালয় শেষ হলে দিয়েছিল প্ল্যাটনারকে। সেদিন চারটি ছেলেকে প্রার্থনার পর আটকে রাখা হয়েছিল স্কুলে পড়া না করতে পারার অপরাধে। দেখাশোনার ভার ছিল প্ল্যাটনারের ওপর। কেমিস্ট্রি পড়ানোর ঘরে কর্তব্য সমাপন করছিল প্ল্যাটনার। আর পাঁচটা বেসরকারি স্কুলের মতো এ স্কুলেও হাতেকলমে কেমিস্ট্রি শেখানোর সরঞ্জাম নিতান্তই সাদাসিধে, ট্রাঙ্ক সাইজের একটা আলমারির মধ্যে ছিল জিনিসগুলো। ফাঁকিবাজ ছাত্রদের ওপর তদারকি বড় একঘেয়ে লাগছিল প্ল্যাটনারের। হুইবল সবুজ গুঁড়ো নিয়ে আসায় তাই খুশি হয়েই তৎক্ষণাৎ আলমারির তালা খুলে বার করেছিল বিশ্লেষণ করার জিনিসপত্র। ভাগ্যক্রমে হুইবল বসেছিল নিরাপদ দূরত্বে। ফাঁকিবাজ ছেলে চারটে মন দিয়ে বাকি পড়া করার ভান করে আড়চোখে চেয়েছিল। প্ল্যাটনারের দিকে। কারণ, মাত্র তিনটে গ্যাসের বিদ্যেবুদ্ধি নিয়ে কেমিক্যাল এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারে নিতান্তই দুঃসাহসী ছিল হঠকারী মাস্টারমশাই। ভয় আর ঔৎসুক্য সেই কারণেই।
পাঁচটা ছেলেই বলেছে একই কথা। প্রথমে অল্প সবুজ গুঁড়ো একটা টেস্টটিউবে ঢেলে নিয়েছিল প্ল্যাটনার। পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা করেছিল জল, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড আর সালফিউরিক অ্যাসিড দিয়ে। কিছু ঘটেনি। সবুজ গুঁড়ো সবুজই থেকেছে। তখন একটা স্লেটের ওপর শিশির অর্ধেক সবুজ গুড়ো ঢেলে নেয় প্ল্যাটনার। ওষুধের শিশিটা বাঁ হাতে ধরে, ডান হাতে দেশলাইয়ের কাঠির আগুন লাগায় সবুজ ডোয়। ধোঁয়া ছেড়ে গলতে থাকে সবুজ গুঁড়ো। আর তারপরেই ফেটে যায় কানের পরদা-ফাটানো শব্দে প্রচণ্ড ঝলকে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে। ঝলক দেখেই বিপর্যয়ের আশঙ্কায় পাঁচটা ছেলেই গোঁত মেরে ঢুকে গিয়েছিল ডেস্কের তলায়। মারাত্মক জখম হয়নি কেউই। জানলা ছিটকে পড়েছিল খেলার মাঠে, আস্ত থাকেনি ইজেলের ওপর রাখা ব্ল্যাকবোর্ড। রেণু রেণু হয়ে গিয়েছিল স্লেটখানা। কড়িকাঠ থেকে খসে পড়েছিল পলেস্তারা। এ ছাড়া স্কুলবাড়ির বা যন্ত্রপাতির কোনও ক্ষতি হয়নি। প্ল্যাটনারকে দেখতে না পেয়ে ছেলেরা ভেবেছিল, নিশ্চয় বিস্ফোরণের সংঘাতে জ্ঞান হারিয়েছে মাস্টারমশাই-পড়ে আছে চোখের আড়ালে ডেস্কের তলায়। লাফিয়ে বেরিয়ে এসে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিন্তু ঘরের মধ্যে প্ল্যাটনারকে দেখতে না পেয়ে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল পাঁচজনেই। ঘর শূন্য–প্ল্যাটনার উধাও! তবে কি জখম হয়ে প্রাণের তাগিদে বাইরে ছিটকে গেছে মাস্টারমশাই? কানে তখনও তালা লেগে রয়েছে। পাঁচজনেরই, চোখে দেখছে ধোঁয়া। সেই অবস্থাতেই হুড়মুড় করে দরজা দিয়ে বেরতে গিয়ে দড়াম করে আছড়ে পড়েছিল প্রিন্সিপ্যাল মি. লিডগেটের ওপর–প্রলয়ংকর বিস্ফোরণে পুরো স্কুলবাড়ি থরথর করে কেঁপে ওঠায় ভদ্রলোক পড়ি কি মরি করে দৌড়ে আসছিলেন কেমিস্ট্রির ঘরে।
একটুতেই ধাঁ করে উত্তেজিত হয়ে ওঠা যাঁর স্বভাব, পিলে চমকানো এই শব্দের পর তাঁর অবস্থাটা অনুমেয়। গায়ের ওপর দমাদম করে ছেলে পাঁচটা আছড়ে পড়ায় তিড়বিড়িয়ে উঠেছিলেন একচোখো প্রিন্সিপ্যাল। গালাগাল বর্ষণ করেই জানতে চেয়েছিলেন, মি. প্ল্যাটনার কোথায়?
পরের কটা দিন এই একই প্রশ্ন শোনা গেছে মুখে মুখে। গেল কোথায় মি. প্ল্যাটনার? পরমাণু হয়ে গেল নাকি? না আছে এক ফোঁটা রক্ত, না আছে জামাকাপড়ের কণামাত্র সুতো। বিস্ফোরণ যেন তাকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে–ধ্বংসাবশেষটুকুও রেখে যায়নি।
ফলে চাঞ্চল্যকর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো তল্লাটে। ধামাচাপা দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন লিডগেট। প্ল্যাটনারের নাম মুখে আনলেই ছাত্রদের পঁচিশ লাইন লেখার সাজা দিয়েছিলেন। ক্লাসে বলতেন, প্ল্যাটনার কোথায় আছে, তা তিনি জানেন। কেমিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে এহেন বিপর্যয়ের ফলে স্কুলের সুনামের হানি ঘটতে পারে, প্ল্যাটনারের অন্তর্ধান রহস্যও স্কুলের নাম ডোবাতে পারে–এই ভয়ে তিনি পুরো ব্যাপারটাকে সহজ করে তুলতে চেয়েছিলেন। ছেলে পাঁচটাকে এমন জেরা করেছিলেন যে, চোখে দেখা ঘটনাকেও শেষ পর্যন্ত চোখের ভ্রান্তি মনে হয়েছিল তাদের কাছে। তা সত্ত্বেও পল্লবিত কাহিনি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল পুরো নটা দিন এবং বেশ কজন অভিভাবক ছেলেদের সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল স্কুল থেকে বিভিন্ন অজুহাতে। প্রতিবেশীরা নাকি স্বপ্ন দেখেছিল প্ল্যাটনারকে। সুস্পষ্ট স্বপ্নগুলো অদ্ভুতভাবে একই রকম। প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, রামধনুর মতো বর্ণবিকাশী ঝকঝকে আলোকপ্রভার মধ্যে হেঁটে চলেছে। প্ল্যাটনার–কখনও একা, কখনও বহু সঙ্গীসহ, মুখ ফ্যাকাশে, উদ্ভ্রান্ত, বিমর্ষ, কয়েক ক্ষেত্রে হাত নেড়ে কী যেন বলতে চেয়েছে স্বপ্ন যে দেখছে, তাকে। কয়েকটি ছেলের স্বপ্ন আরও বিদঘুটে। প্ল্যাটনার যেন অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে কাছে এসে চোখে চোখে চেয়ে রয়েছে। দুঃস্বপ্নের প্রভাব নিঃসন্দেহে৷ কয়েকজন ছাত্র প্ল্যাটনারকে নিয়ে চম্পট দিয়েছে স্বপ্নের মধ্যে–কেননা, কারা যেন ধরতে আসছে প্ল্যাটনারকে। তাদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা গেছে, এরকম গোল গোল আকারের কিম্ভুতকিমাকার প্রাণী ইহলোকের এই ধরাধামে কখনও কেউ দেখেনি। নদিন পর বুধবারে প্ল্যাটনার ফিরে আসতেই অবসান ঘটেছিল সমস্ত জল্পনা-কল্পনার। তার ফিরে আসাটাও উধাও হওয়ার মতোই চমকপ্রদ। বুধবার সন্ধ্যায় বাগানে লিচু পেড়ে খাচ্ছিলেন মি. লিডগেট। বেশ বড় বাগান। আইভি ছাওয়া উঁচু লাল ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাইরে থেকে ভেতরের দৃশ্য দেখা যায় না। ফলভারে নুয়ে-পড়া বিশেষ একটা গাছের দিকে যেই মন দিয়েছেন ভদ্রলোক, অমনি তীব্র ঝলক দেখা দিয়েছিল শূন্যে, ধুপ করে শোনা গিয়েছিল একটা ভারী আওয়াজ। ঘুরে তাকানোর আগেই একটা গুরুভার বস্তু আছড়ে পড়েছিল পিঠে। প্রচণ্ড ধাক্কায় ভদ্রলোক হাতে লিচু নিয়েই মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন বাগানের মাটিতে–সিল্কের টুপি কপালে এঁটে বসে গিয়ে ঢেকে দিয়েছিল একটিমাত্র চোখের বেশ কিছুটা, পিঠে আছড়ে-পড়া বস্তুটা হঠাৎ করে হড়কে গিয়ে লিচু গাছের ওপরে পড়তেই চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে উঠে বিমূঢ় মি. লিডগেট দেখেছিলেন নিখোঁজ প্ল্যাটনার সটান বসে তাঁর সামনে। মাথায় টুপি নেই। জামাকাপড় এবং চুল লন্ডভন্ড। শার্টের কলার উধাও। হাতে রক্ত, চটকানো লিচু মুঠোয় ধরে ওই অবস্থাতেই রেগে টং হয়ে প্ল্যাটনারকে নাকি একহাত নিয়েছিলেন প্রিন্সিপ্যাল মশায় এহেন অভব্য আচরণের জন্যে।