গটফ্রায়েড প্ল্যাটনারের নামটা খটমট হতে পারে, কিন্তু জন্মসূত্রে সে খাঁটি ইংরেজ। তার বাবা ছিল অ্যালসেশিয়ান, ইংল্যান্ডে এসেছিল ছয়ের দশকে, বিয়ে করেছিল খানদানি ইংরেজ মেয়েকে, সারাজীবন কোনওরকম অভাবনীয় ঘটনা না ঘটিয়ে এবং প্যাটার্ন অনুযায়ী সাজানো কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে মেঝে আচ্ছাদন করে মারা যায় ১৮৮৭-তে। গটফ্রায়েডের বয়স সাতাশ, জন্মসূত্রে তিন-তিনটে ভাষায় দখল থাকার ফলে সে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের একটা ছোট্ট বেসরকারি বিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষাসমূহের শিক্ষক। শিক্ষাগত ব্যাপারে অন্যান্য যে কোনও বেসরকারি বিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষাসমূহের শিক্ষকের থেকে তার কোনও পার্থক্য নেই। তার জামাকাপড়ও খুব দামি বা শৌখিন নয়–যাচ্ছেতাই সস্তা বা নোংরাও নয়, গায়ের রং, উচ্চতা, চলাফেরা চোখে পড়ার মতো নয়। লক্ষ করলেই দেখবেন, বেশির ভাগ লোকের মতোই তার মুখের দুপাশ হুবহু এক নয়–একই অনুপাতে গড়া নয়, ডান চোখটা বাঁ চোখের চাইতে সামান্য বড়, ডানদিকের চোয়ালটাও একটু বেশি ভারী। আর পাঁচজনের মতো খুঁটিয়ে দেখার অভ্যেস আপনার না থাকলে তার খোলা বুকে কান পেতে ধুকপুকুনি শুনেও আপনার মনে হবে সে দশজনেরই একজন– কোনও তফাতই নেই। কিন্তু দক্ষ পর্যবেক্ষকের সঙ্গে আপনার পার্থক্য কিন্তু এইখানেই। ওর হৃৎপিণ্ড অতি মামুলি মনে হতে পারে আপনার কাছে, দক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছে নয়। ধরিয়ে দেওয়ার পর খটকা লাগবে আপনারও। কারণ, গটফ্রায়েডের হৃদযন্ত্র ধুকুর পুকুর করে চলেছে বুকের বাঁদিকে নয়–ডানদিকে।
এইটাই কিন্তু একমাত্র সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার নয় গটফ্রায়েডের দৈহিক কাঠামোয়। পাকা শল্যচিকিৎসকের পরীক্ষায় ধরা পড়ে আরও অনেক অদ্ভুত ব্যাপার। শরীরের অন্যান্য যেসব দেহাংশ সুসমঞ্জস, সুষম নয়–তার প্রতিটি একইভাবে বসানো রয়েছে উলটোদিকে। যকৃতের ডান অংশ এসেছে বাঁদিকে, বাঁ অংশ ডানদিকে; ফুসফুসও উলটো-পালটা। গটফ্রায়েড কস্মিনকালেও কুশলী অভিনেতা নয়। তা সত্ত্বেও সম্প্রতি তার ডান হাত আর বাঁ হাতের ব্যবহারও যেন উলটো-পালটা হয়ে গেছে। সবচেয়ে পিলে চমকানো ব্যাপার কিন্তু এইটাই। অদ্ভুত সেই কাণ্ডকারখানার পর থেকেই সে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে বাঁ হাতে লিখতে গিয়ে। ডান হাত ছুঁড়তে পারে না আগের মতো, খেতে বসে বড় বেকায়দায় পড়ে ছুরি-কাঁটা-চামচ নিয়ে। মহাবিপদে পড়ে রাস্তায় সাইকেল চালাতে গিয়ে। ডানদিক-বাঁদিক গুলিয়ে ফেলে। বিচিত্র এই ব্যাপারের আগে গটফ্রায়েড কিন্তু ল্যাটা ছিল না–সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব নেই। আগেই বলেছি, ছলচাতুরী তার কোষ্ঠীতে লেখা নেই–থাকলে এই অসংগত কাণ্ডকারখানার ব্যাখ্যা পাওয়া যেত।
চক্ষু-স্থির-করা এবং চমকপ্রদ আর-একটা ব্যাপারও শুনে রাখুন। নিজের তিনখানা ফোটোগ্রাফ হাজির করেছিল গটফ্রায়েড। পাঁচ-ছবছর বয়সের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, মোটাসোটা পা ছুড়ছে ক্যামেরাম্যানের দিকে। এ ছবিতে দেখবেন, বাঁ চোখটা ডান চোখের চাইতে একটু বড়। বাঁদিকের চোয়ালও একটু ভারী। এখন কিন্তু ওর চোখ আর চোয়ালের ছবি ঠিক তার বিপরীত। চোদ্দো বছরের ছবিতে অবশ্য এই বিপরীত অবস্থাই দেখা যাবে। তার কারণ, ওই সময় জেম পদ্ধতিতে সরাসরি ধাতুর প্লেটে ছবি তোলার রেওয়াজ ছিল –আয়নায় যেমন উলটো হয়ে ছবি পড়ে, ফোঁটাগ্রাফিক প্লেটেও তেমনি পড়ত। একুশ বছর বয়সে তোলা তৃতীয় ফোটোগ্রাফে কিন্তু দেখবেন, শৈশবে ওর ডানদিক-বাঁদিক যেরকম ছিল, তখনও তা-ই আছে। এই থেকেই প্রমাণিত হয় যে, গটফ্রায়েডের ডানদিক আর বাঁদিকের মধ্যে অদলবদল ঘটেছে হালে। নরদেহের এই ধরনের অত্যাশ্চর্য অদলবদল প্রকৃতই ফ্যান্টাস্টিক এবং অর্থহীন অলৌকিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছু হতে পারে কি?
গটফ্রায়েড নিজেও তো ধাঁধায় পড়েছে। অসম্ভব এই দেহাংশ বদলাবদলি নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে মুখ লাল করে ফেলে। কাউকে বিশ্বাস করানোর জন্যে কোনও মাথাব্যথাই নেই–মুখ খুলতেই চায় না। চরিত্র আগে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। অর্থাৎ, ওর অন্তর-প্রকৃতি পালটায়নি–পালটেছে কেবল বাইরেটা এবং তার জন্যে বেচারি নিজেও ভারী লজ্জিত। চিরকালই সে মুখচোরা, স্বল্পভাষী, ধীরস্থির, বাস্তব-বুদ্ধিসম্পন্ন, বিয়ার পছন্দ, ধূমপানে অরুচি নেই, নিত্য ভ্রমণ-ব্যায়ামে অভ্যস্ত, শিক্ষাদানের ব্যাপারে উঁচুমান বজায় রাখতে সজাগ। কণ্ঠস্বর মার্জিত, গান গাইতেও পারে। বই পড়ার নেশা আছে, ঘুমায় মড়ার মতো, স্বপ্ন দেখে কদাচিৎ। ফ্যান্টাস্টিক এই উপকথা রচনা করার মতো মানুষই নয়। ফোটোগ্রাফ নকল করা যায়, ল্যাটা হওয়ার অভিনয় করা যায় কিন্তু চরিত্রগত এই বৈশিষ্ট্যগুলো তো থেকে যাচ্ছে।
শবব্যবচ্ছেদ মারফত দেহাংশের বদলাবদলি সপ্রমাণের প্রস্তাব গটফ্রায়েডের মনঃপূত নয় মোটেই। সুতরাং তার মুখের গল্পকেই মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। স্থান-এর মধ্যে দিয়ে কোনও মানুষকে নিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় আমাদের জানা নেই–যদি তা সম্ভব হত, তাহলেই তার ডানদিক-বাঁদিক পালটা-পালটি হতে পারত। যা-ই করুন-না কেন, ওর ডানদিক এখনও ডানদিকেই রয়েছে, বাঁদিক রয়েছে বাঁদিকে। খুব পাতলা, চ্যাপটা জিনিস নিয়ে আপনি এই বদলাবদলি ব্যাপারটা করতে পারেন। কাগজ কেটে একটা মূর্তি বানিয়ে উলটে নিলেই হল। কিন্তু নিরেট মূর্তি নিয়ে তা হয় না। গণিতবিদদের তত্ত্ব অনুযায়ী নিরেট দেহের ডানদিক-বাঁদিক অদলবদল করে দেওয়া যায় দেহটাকে সটান স্থান থেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে–অস্তিত্বের বাইরে নিয়ে গিয়ে। স্থান-এর বাইরে নিয়ে যেতে হবে। বিষয়টা দুর্বোধ্য। কিন্তু গণিত জানা থাকলে নিগুঢ় নয়। তাত্ত্বিক ভাষায়, ফোর্থ ডাইমেনশন অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক জগৎ ছাড়িয়ে চারমাত্রিক জগতে পরিভ্রমণ করে এসেছে গটফ্রায়েড–ডানদিক আর বাঁদিক অদলবদলটাই তার প্রমাণ। গালগল্প শুনছি না যদি মেনে নেওয়া যায়–তাহলে ঠিক তা-ই হয়েছে। অকাট্য ঘটনাবলির ফিরিস্তি এখানেই শেষ করা যাক। এবার আসা যাক চমকপ্রদ সেই ঘটনার বর্ণনায়, যার পর থেকে প্ল্যাটনার অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল এই জগতের বাইরে। সাসেক্সভিল প্রোপ্রাইটারি স্কুলে প্ল্যাটনার ভাষা ছাড়াও পড়াত কেমিস্ট্রি, ভূগোল, হিসেব রাখার বিদ্যে, শর্টহ্যান্ড, ড্রয়িং এবং আরও অনেক বিষয়–ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের চাহিদা অনুযায়ী। সব বিষয়ে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য না থাকলেও কিছু অসুবিধে হত না। মাধ্যমিক শ্রেণিতে শিক্ষকদের শিক্ষার মান নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। সবচেয়ে জ্ঞান কম ছিল কেমিস্ট্রিতে–তিনটে গ্যাসের অস্তিত্ব ছাড়া আর কোনও খবর রাখত না– গ্যাস তিনটের নাম কী কী, তা-ও সঠিক জানত না। ছাত্রছাত্রীরা জানত আরও কম। ফলে, মাঝে মাঝে বড় বেকায়দায় পড়ত প্ল্যাটনার। হুইল নামে একটি ছেলের জ্ঞানের স্পৃহা ছিল একটু বেশি–নিশ্চয় কোনও আত্মীয়ের নষ্টামি–শিখিয়ে দিয়েছিল মাটারমশায়কে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে। প্ল্যাটনারের বক্তৃতা মন দিয়ে শুনত হুইল–কখনও সখনও রকমারি দ্রব্য এনে দিত প্ল্যাটনারকে। সুযোগ পেয়ে উৎসাহে ফুলে উঠত প্ল্যাটনার। বিশ্লেষণ করত, মতামতও শোনাত। বাড়ি বসে অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রিও পড়ে নিয়েছিল। অবাক হয়েছিল কেমিস্ট্রি শাস্ত্রের মধ্যে এত কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় আছে জেনে।