বোমার মতো ফেটে পড়েছিল হ্যারিঙ্গওয়ে। খোদ শয়তানের মুখে এ ধরনের সমালোচনা সে আশা করেনি।
বলেছিল, খবরদার! আমার স্টুডিয়োতে বসে আমাকে হেনস্থা করলে পস্তাতে হবে বলে দিচ্ছি৷
বলতে বলতে তুলে ধরেছিল লাল রঙে বোঝাই শূকর-কেশের বারো নম্বর মোটা তুলিটা।
ভ্রূক্ষেপ করেনি জ্ঞানদাতা ছবি–খাঁটি শিল্পী জেনো ছেলেমানুষের মতো অজ্ঞান হয়, জ্ঞানের মটমটানি থাকে না ভেতরে। যে শিল্পী নিজের সৃষ্টি নিয়ে তত্ত্ব রচনা করে চলে, সে কিন্তু শিল্পী থাকে না-সমালোচক হয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়াও দাঁড়াও! লাল রংটা তুললে কেন?
লালে লাল করে দেব বলে–লাল পরদা বানিয়ে ছাড়ব তোমাকে। আমারই স্টুডিয়োতে বসে আমাকে লেকচার দেওয়া?
শুনেই নাকি দারুণ ঘাবড়ে গিয়েছিল ছবি–অত হড়বড় করার কী আছে? কথাটা শেষ করতে দাও?
না…
শোন, শোন, তোমার ভালো করব বলেই এসেছি আমি। প্রেরণা জিনিসটা তোমার মধ্যেই নেই। আমি জুগিয়ে যাব। কোলনের ক্যাথিড্রালের নাম শুনেছ? শয়তানের সেতু?
রাবিশ! তোমার কথা শুনে বস্তাপচা সস্তা নাম কিনে নরকে তলিয়ে যাই আর কী! নাও ধর! ফিরে যাও জাহান্নমে!
হ্যারিঙ্গওয়ের মাথায় নাকি তখন রক্ত চড়ে গিয়েছিল। একতাল লাল রং নিয়ে খুঁজে দিয়েছিল ছবির প্রাণীর মুখের মধ্যে। ভীষণ চমকে গিয়ে থুথু করে রং ফেলবার চেষ্টা করেছিল ইতালিয়ান বেচারা।
তারপরেই নাকি শুরু হয়ে গিয়েছিল অত্যাশ্চর্য ধস্তাধস্তি। লাল রং ছিটিয়ে গেছে হ্যারিঙ্গওয়ে সমানে–প্রতিবারই দুমড়ে-মুচড়ে শরীরটাকে তুলির পোঁচের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়েছে ছবির প্রাণী। সেই সঙ্গে দর কষাকষি চালিয়ে গেছে তারস্বরে–জোড়ানিধি পাবে হে শিল্পী! দু-দুটো উৎকৃষ্ট ছবি–বিনিময়ে যা বলব তা শুনতে হবে, কেমন? দাম পছন্দ? এক ধ্যাবড়া রং ছুঁড়ে দিয়ে জবাবটা দিয়েছিল হ্যারিঙ্গওয়ে মুখে কোনও কথা না বলে!
মিনিটকয়েক কেবল ঘচাঘচ তুলি ছোঁড়া, রং ছিটকে পড়া আর ইতালিয়ানের তারস্বরে চিৎকার ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যায়নি। হাত আর বাহু দিয়ে বেশ কয়েকটা তুলির পোঁচ রুখে দিলেও হ্যারিঙ্গওয়ে বাধা পেরিয়ে জ্যাবড়া জ্যাবড়া রং লাগিয়ে দিয়েছিল চোখে মুখে-নাকে। কিন্তু এভাবে এন্তার রং ছড়ালে প্যালেটের রং তো ফুরাবেই। হ্যারিঙ্গওয়ের রং শূন্য হল একসময়ে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল হাপরের মতো। ছবি দেখে মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র গড়াগড়ি দিয়ে এল কসাইখানায়। ভিজে রং ঘাড় বেয়ে টসটস করে গড়িয়ে পড়ায় খুব অস্বস্তিও হচ্ছে ছবির প্রাণীর, তা সত্ত্বেও লড়াইয়ের প্রথম টক্করে জিতেছে সে-ই। সুতরাং লাল রঙের বেধড়ক মার খেয়েও গোঁ ছাড়েনি। নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে যেই বলেছে, দু-দুটো খাঁটি ছবির বিনিময়ে একখানা শয়তানের আত্মা-জাগানো ছবি–অমনি ধাঁ করে স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে সোজা বউয়ের সাজঘরের দিকে দৌড়েছিল হ্যারিঙ্গওয়ে।
ফিরে এসেছিল এক টিন সবুজ এনামেল পেন্ট আর একটা মোটা বুরুশ নিয়ে। দেখেই গলার শির তুলে চেঁচিয়ে উঠেছিল শিল্পী শয়তান, তিনটে… তিন-তিনটে সেরা ছবি বিনিময়ে একখানা…।
হ্যারিঙ্গওয়ের সবুজ রং ঝপাত করে এসে পড়েছিল শয়তানের লাল চোখে।
গার্গল করার মতো ঘড়ঘড়ে গলায় তবু মিনতি জানিয়েছিল শয়তান, চারখানা মাস্টারপিস, বিনিময়ে…।
হ্যারিঙ্গওয়ে আর দাঁড়ায়? মোটা বুরুশের এক-এক পোঁচে সবুজে সবুজ করে আনল লাল রং-ছেটানো শয়তানকে। দেখতে দেখতে সবুজ হয়ে গেল গোটা ক্যানভাসটা। গড়ানে রঙের ফাঁক দিয়ে চকিতের মতো উঁকি দিয়েছিল মুখটা। পাঁচখানা মাস্টারপিস বলার সঙ্গে সঙ্গে ঝপাস করে মুখের ওপরের এক পোঁচ মেরে দিয়েছিল হ্যারিঙ্গওয়ে। পরক্ষণেই গড়ানে রঙের ফাঁক থেকে একখানা লাল চোখ বেরিয়ে পড়ে বিষম ঘৃণায় প্যাটপ্যাট করে চেয়েছিল তার দিকে। হ্যারিঙ্গওয়ের হাত ঝড়ের মতো তৎক্ষণাৎ ধেয়ে গিয়েছিল সেইদিকে। অচিরেই চকচকে সবুজ এনামেল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। দ্রুত শুকিয়ে আসছে রং –তা সত্ত্বেও কিছুক্ষণ ধরে এদিকে-সেদিকে রঙের আস্তরণ ফুলে ফুলে উঠেছিল তলার চাপে। তারপর নিথর হয়ে গেল ক্যানভাস। মৃত্যু হল ছবির।
পাইপ ধরিয়ে বসে পড়েছিল হ্যারিঙ্গওয়ে। শুধু একটা আপশোস থেকে গেছে আজও। ফোটো তুলে রাখা উচিত ছিল শয়তানের।
সবুজ গুঁড়ো
সবুজ গুঁড়ো ( The Plattner Story)
[‘The Plattner Story’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The New Review’ পত্রিকায় এপ্রিল ১৮৯৬ সালে। ১৮৯৭ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের ছোটগল্পের সংকলন ‘The Platmer Story and Others’ বইটিতে গল্পটি স্থান পায়। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘The Country of the Blind and Other Stories’ সংকলনটিতেও গল্পটি স্থান পায়।]
গটফ্রায়েড প্ল্যাটনারের গল্পকে পাত্তা দেওয়া, না-দেওয়া পুরোটাই নির্ভর করছে সাক্ষ্যপ্রমাণ কতখানি বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। এদিকে রয়েছে সাতজন সাক্ষী। সঠিকভাবে বলতে গেলে সাড়ে ছজোড়া চোখ আর একটা এমনই ঘটনা, যা না মেনে উপায় নেই। অপরদিকে রয়েছে কুসংস্কার, উপস্থিতবুদ্ধি আর মতামতের জড়তা। যে সাতজন সাক্ষীর কথা বললাম, এদের চাইতে সরূপী সাক্ষী আদৌ আর হয় বলে মনে হয় না; প্ল্যাটনারের শারীরস্থান উলটে যাওয়ার মতো না-মেনে-উপায়-নেই ঘটনাও আর ঘটেছে বলে জানা নেই; এবং সাতজনেই যে কাহিনিটা শুনিয়েছে, তার মতো অসম্ভব গল্পও আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি! এই সাতজনের মধ্যে প্ল্যাটনারকেও আমি ধরেছি এবং কাহিনির মধ্যে সব চাইতে অসম্ভব অংশটা তারই অবদান। একদিকে জবরদস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ, আর-একদিকে নিরেট কুসংস্কার। অবস্থা আমার শোচনীয় হবে বুঝতেই পারছি। কোথাও একটা বক্রতা আছে এ ব্যাপারে কিন্তু তা কী ধরনের, তা জানি না। অবাক হয়েছি গণ্যমান্য মহলে এমন একটা উদ্ভট কাহিনি দারুণ পাত্তা পাওয়ায়–একেবারেই আশা করা যায় না। এইসব বিবেচনা করেই গল্পটাকে বরং সরাসরি শুনিয়ে দেওয়াই ভালো–বেশি মতামত আর জাহির করতে চাই না।