এইভাবেই এখানে-সেখানে একটু করে রং ছুঁইয়ে দূরে সরে গিয়ে ঘাড় কাত করে দেখে হ্যারিঙ্গওয়ে। একটু একটু করে আগের চাইতেও জ্যান্ত হয়ে উঠছে ছবিটা ঠিকই কিন্তু মন-খুশ ছবি হচ্ছে না মোটেই। এমন কুটিল মুখ তো হ্যারিঙ্গওয়ে চায়নি। জীবনে এরকম অশুভ ভাবভরা মুখচ্ছবি কখনও আঁকেনি শিল্পীমশায়। ছবি কখনও এরকম জ্যান্তও হয়নি। তার হাতে।
কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্র নয় হ্যারিঙ্গওয়ে। তাচ্ছিল্যের ওই হাসি উড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত রং-তুলি চালিয়ে গেল সমানে। সে ভাবটা গেল তো স্পষ্ট হয়ে উঠল চোখের চাপা আগুন। এতক্ষণ এই দ্যুতি কিন্তু চোখে পড়েনি। সারা মুখখানায় যেন শয়তানি মাখানো।
কেন এরকম হল? ভুরু দুটো কি বেশি তেরচা হয়ে গেছে? খড়খড়ি আরও খুলে দিয়ে জোর আলোয় রং-তুলি নিয়ে ফের হুমড়ি খেয়ে বসল হ্যারিঙ্গওয়ে।
ক্যানভাসের ওপরে মুখটা সজীব রয়েছে যেন আত্মার প্রাণস্পন্দনে। কিন্তু পৈশাচিক ভাবটা জাগ্রত হচ্ছে কী জন্যে, কিছুতেই তা আবিষ্কার করে উঠতে পারে না হ্যারিঙ্গওয়ে। অসম্ভব! আরও এক্সপেরিমেন্ট দরকার মনে হচ্ছে। ভুরু দুটোর দিকে তাকিয়ে কিন্তু তাজ্জব হয়ে যায় বেচারা। ও কি ভুরু? না অন্য কিছু? ওই জন্যেই মুখটা কি অমন নারকীয়? ধুত্তোর! রং-তুলি যখন হাতেই রয়েছে, বিকট ভুরুকে সহজ করে তোলা এমন কী শক্ত কাজ। ভুরু পালটে গেল চক্ষের নিমেষে। কিন্তু তাতেও কমল না মুখের ভয়াবহতা –আর ওই গা-জ্বালানো তাচ্ছিল্যের হাসি! আরও শয়তান-শয়তান হয়ে ওঠে গোটা মুখটা। কী জ্বালা! কী জ্বালা! মুখের কোণটায় একটু তুলি বোলালে হয় না? শ্লেষ হাসি অমনি পালটে গিয়ে দাঁত বার-করা হাড়পিত্তি-জ্বালানো হাসি যেন নিঃশব্দে টিটকিরি দিয়ে যায় হ্যারিঙ্গওয়েকে। তাহলে গলদ আছে চোখে? যাচ্চলে! তুলিতে উঠে এসেছে টকটকে সিঁদুর রং লাগানোও হয়ে গেল ওই রং! অথচ বেশ খেয়াল ছিল, তুলছে বাদামি রং!
টকটকে লাল চোখজোড়া এখন যেন অক্ষিকোটরে পাক দিয়ে কটমট করে চেয়ে আছে। হ্যারিঙ্গওয়ের দিকে। চোখ তো নয়–আগুনের গোলক বললেই চলে।
তড়িঘড়ি বেশ খানিকটা উজ্জ্বল লাল রং-তুলি বোঝাই করে তুলে নিয়েছিল হ্যারিঙ্গওয়ে। একটু যেন ভয়ত্রস্ত হয়েই ঘচাঘচ করে তুলি বুলিয়েছিল ছবির ওপর দিয়ে। আড়াআড়িভাবে। তারপরেই ঘটে গেল ভারী অদ্ভুত একটা ব্যাপার। অদ্ভুত বলে অদ্ভুত! কিন্তু আদৌ তা ঘটেছিল কি না তা-ই বা কে জানে?
ছবির শয়তান ইতালিয়ান অর্গানবাদক সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে, মুখ কুঁচকে, হাত তুলে সমস্ত রং মুছে ফেললে মুখের ওপর থেকে!
পরক্ষণেই ফের খুলে গেল লাল চোখ। ফট করে ঠোঁট খোলার মতো আওয়াজও হল একটা। সুড়ত করে হাসি ভেসে গেল মুখের ওপর দিয়ে।
কথা কয়ে উঠল ছবি, ঝোঁকের মাথায় কী যে কর?
এতক্ষণ ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল নাকি হ্যারিঙ্গওয়ে–কিন্তু যা ঘটবার নয় তা-ই যখন ঘটে গেল, তখন আর কীসের ভয়? নিমেষে আত্মস্থ হয়ে ওঠে শিল্পীমশায়। ছবির শয়তান খুব একটা হাড়বজ্জাত হবে বলে মনে যখন হচ্ছে না, তখন কোমর বেঁধেই লাগা যাক তার সঙ্গে।
কড়া গলায় বলে হ্যারিঙ্গওয়ে, তুমিই বা কম যাও কীসে? এত নড়াচড়া কেন? মুখ ভেংচে, চোখ টিপে, ব্যঙ্গের হাসিই বা কেন?
আমি? আকাশ থেকে পড়ে যেন ছবি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি।
আমি তো কিছু করিনি।
একশোবার তুমি করেছ।
আজ্ঞে না মশায়, গোলমালটা তুমিই পাকিয়েছ, বলে ছবি।
তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে হ্যারিঙ্গওয়ে, ইয়ারকি হচ্ছে?
পাগল, ওসব আমার পোষায় না।–আরে, আরে, কর কী? কর কী? আবার তুলি দিয়ে মারবে নাকি? পাগলামি ছাড়। যা সত্যি, তা শুনলে খারাপ তো লাগবেই। কিন্তু সকাল থেকে কী চেষ্টাই না করছ, আমি যা নই, ঠিক সেইভাবে আমাকে আঁকতে। নিজেই জান না কী আঁকতে চাও, দোষ আমার না তোমার?
ফটফট করো না। কী আঁকতে চাই, সে জ্ঞান আমার বিলক্ষণ আছে।
একেবারেই নেই। কস্মিনকালেও ছিল না, ছবিদের সঙ্গে তোমার প্রাণের কোনও সম্পর্কই নেই, তাই কোনও ছবিই শেষ পর্যন্ত জ্যান্ত ছবি হয়ে ওঠে না। আবছা ধারণা নিয়ে শুরু কর, তারপর চলে পরীক্ষানিরীক্ষা, বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে পড়ার মতো রং খুলে গেল তো ভালো, নইলে নয়। ঠিক কী আঁকতে চাও, গোড়া থেকেই সেই ধারণা স্পষ্ট থাকে না বলেই কেলোর কীর্তি চালিয়ে যাও। ছ্যা! ছ্যা!
গাঁ-গাঁ করে হ্যারিঙ্গওয়ে নাকি তখন বলেছিল, আমি ছবি আঁকব আমার মর্জিমাফিক তোমার তাতে কী?
প্রেরণা ছাড়া ছবি আঁকতে তো পারবে না, একটু হতাশ হয়েই বলেছিল ছবি।
প্রেরণা নেই কোনও–বলছ? প্রেরণা!
ঘৃণায় নাক-ফাক কুঁচকে একাকার করে বলেছে ছবি, রাস্তায় যাচ্ছিল একজন অর্গানবাদক। মুখ তুলে চাইল তোমার জানলার দিকে। দেখেই প্রেরণা এসে গেল তোমার মাথায়? ধর্মচর্চার জন্যে রাত্রি জাগরণ? ফুঃ! প্রেরণার প্রত্যাশায় বসে থাক–প্রেরণা তোমার দিকে ফিরেও চায় না। দেখেই মায়া হল আমার। তাই তো ভাবলাম, যাই, কিছু জ্ঞান দিয়ে আসি।
লাল লাল চোখ মটকে মুচকি হেসে ফের বলেছিল ছবি, বেশি জেনে ছবি আঁকতে শুরু কর বলেই ছবিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে পার না। বুঝলে হাঁদারাম? জ্ঞানে মটমট করছ বলেই অজানাকে জ্ঞানের সীমানায় ঢুকতে দাও না, ছবির মধ্যে আত্মা বেচারিও ঢোকার পথ খুঁজে পায় না। গলদ তোমার এইখানেই। একটু যদি কম জানতে…