একজন বলে উঠেছিল, মেশিন বানিয়ে নিলেই হত।
কী! বীরদর্পে রুখে উঠল সেই কাঠখোট্টা করলোরাল-কামারগিরি করব আমি?
খবরটার শিরোনমাটা তৎক্ষণাৎ মাথায় এসে গেল সাংবাদিকের মানুষ বনাম কামারগিরি!
মেশিনের তলায় পিষ্ট মানবতা!
মেশিনগুলোর মধ্যে নীল পাজামা পরে জনা ছয়েক তরুণ তখন হৃষ্টচিত্তে কফি আর বিস্কুট খেতে খেতে মেশিনের জয়গানই করছে।
সুতরাং, জয় হোক বিজ্ঞানের!
———— [অনুবাদকের কথাঃ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। প্রথম ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৬ সালে সোমি-তে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডাঙার লড়াইয়ে মূল ভূমিকা নিয়েছিল ট্যাঙ্ক-বাহিনী। সুতরাং গল্পটিকে সার্থক কল্পবিজ্ঞান বলা যায়। ১৯০৩ সালে যা ছিল আজগুবি, ১৯১৬ সালে তা-ই হল বিস্ময়।]
শয়তানের ছবি
শয়তানের ছবি ( The Temptation of Harringay )
[‘The Temptation of Harringay’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘The St. Jamess Gazette’ পত্রিকায়। ১৮৯৫ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের প্রথম ছোটগল্পের সংকলন ‘The Stolen Bacillus and Other Incidents’-তে গল্পটি স্থান পায়।]
আশ্চর্য এই কাণ্ড আদৌ ঘটেছিল কি না বলা কঠিন। হ্যারিঙ্গওয়ের মুখে শোনা তো–তার কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। হ্যারিঙ্গওয়ে–আর্টিস্ট হ্যারিঙ্গওয়ে। আর্টের কিছু বুঝুক-না বুঝুক, ছবি আঁকে। নিজের কথাতেই সাতকাহন। কল্পনা বস্তুটা মগজে খুবই কম। তবুও এঁকে যায় ছবি–সে ছবি সবসময়ে যে ছবি হয়ে ওঠে না–তা জেনেও ছবি আঁকার নেশা ছাড়তে পারে না।
বিচিত্র এই কাহিনি তারই মুখে শোনা।
বিচিত্র বলে বিচিত্র! দশটা নাগাদ একদিন স্টুডিয়োতে গিয়ে হ্যারিঙ্গওয়ে আগের দিন আঁকা ইতালিয়ান অর্গানবাদকের ছবিটা খুঁটিয়ে দেখছিল। শিল্পী মানুষ তো, বড্ড খুঁতখুঁতে। ছবি পছন্দ হয়নি।
যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তা-ই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন, এই আপ্তবাক্যটি অনুসরণ করেই রাস্তা থেকে অর্গানবাদককে ধরে এনে ক্যানভাসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসিয়েছিল হ্যারিঙ্গওয়ে। পয়সার খাঁকতি ছিল বাদকমশায়ের। চোঙা ঘুরিয়ে বাজনা বাজিয়ে পথে পথে দু-চার পেনি পেলেই যে বর্তে যায়, শিল্পী হ্যারিঙ্গওয়ে তাকে। কবজায় এনে ফেলেছিল সহজেই। মহৎ সৃষ্টি করতে গেলে পথের ভিখিরিদের দিকেই নজর রাখতে হয়।
হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে তাকে এমনভাবে হাসতে বলেছিল যেন দেখলেই মনে হয়, পেনির প্রত্যাশায় বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু মাড়ি বার করলে চলবে না, মাড়ি আঁকার জন্যে এত মেহনত করতে বসেনি হ্যারিঙ্গওয়ে, দাবড়ানি দিয়ে তা বোঝাতে কসর করেনি শিল্পীমশায়। হাসির মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে মনের অতৃপ্তি, তবেই তো ছবি খুলবে ভালো।
ব্যারেল-অর্গান নিয়ে বিদেয় হয়েছিল বাদকমশায়। টেনে ঘুমিয়ে রাত কাবার করে শিল্পীমশায়ের কিন্তু মনে হয়েছিল, ছবিটা মোটেই সুবিধের হয়নি। ঘাড়ের কাছে একটু তুলি বোলাতে পারলে মনে হয় উতরে যাবে
শুরু হল পায়চারি স্টুডিয়োর মধ্যে। নানান দিক থেকে ঘাড় কাত করে নিজের সৃষ্টিকে দেখল নানানভাবে। শেষকালে যে অশ্লীল শব্দটা উচ্চারণ করেছিল, সেটা বর্তমান কাহিনিতে বাদ দেওয়া হল।
তারপর বলেছিল নিজের মনে, নিছক একটা ছবি যদি হত, মনটা খচখচ করত না। কিন্তু জীবন্ত মানুষের ছবি এঁকে সেই ছবিকে যদি জীবন্ত করে তুলতে না পারি, তাহলে করলামটা কী? ধুত্তোর! নিশ্চয় গলদ রয়েছে আমার কল্পনা করার ক্ষমতায়, কিছুতেই কোনও ছবিকে জীবন্ত করতে পারি না।
খাঁটি কথা! হ্যারিঙ্গওয়ের মস্ত গলদ ওইখানেই–কল্পনাশক্তির ঘাটতি নিয়ে শিল্পী হওয়া কি সম্ভব?
মনে মনে তাই সমানে গজগজ করে যায় হ্যারিঙ্গওয়ে। ঝাল ঝাড়ে নিজের ওপরেই। গিরিমাটি রং দিয়ে আদমকে যেমন রঙিন করা হয়েছিল, সেইভাবেই রং দেওয়া দরকার ছবির মানুষে। কিন্তু দূর দূর! এ কি একটা ছবি হয়েছে। অথচ রাস্তায় হাঁটলেই ছবির মতোই স্টুডিয়ো-চিত্র দেখা যায়। স্টুডিয়োতে ঢুকলেই তা অন্যরকম! পালটে যায় খোকাখুকুরও!
জানলার খড়খড়ি তুলে দিল হ্যারিঙ্গওয়ে। আলো আসুক ঘরে। তারপর রং, তুলি, প্যালেট তুলে নিয়ে এল ছবির সামনে। এক পোঁচ বাদামি রং লাগালে মুখের কোণে। তারপর তন্ময় হল চোখের তারা নিয়ে। শেষকালে মনে হল চিবুকটি বড় বেশি ঔদাস্যে ভরা–ধর্মচর্চার জন্যে যে মানুষ রাত জাগে–এরকম উদাস ভাব তাকে মানায় না। ছবিটার নাম দিয়ে বসেছে কিন্তু সেইভাবেই–ধর্মচর্চার জন্যে রাত্রি জাগরণ।
কিছুক্ষণ পর আঁকার সরঞ্জাম নামিয়ে রেখে পাইপ নিয়ে বসল। ধূমপান করে মাথা সাফ করা দরকার। ঠায় চেয়ে রইল ছবির দিকে। মনে হল যেন ছবির মানুষটা নাক সিটকিয়ে তাকে উপহাস করছে।
সত্যিই জান্তব ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে ছবিতে। তবে যেভাবে হ্যারিঙ্গওয়ে চেয়েছিল, সেভাবে হয়নি। উপহাস ভাবটা অতিশয় সুস্পষ্ট। হেয়জ্ঞান করছে শিল্পীকে। শিল্পীর ক্ষমতায় যেন তিলমাত্র বিশ্বাস নেই। ঠিক এইভাবে ছবিকে সজীব করতে চায়নি হ্যারিঙ্গওয়ে। বাঁদিকের ভুরুটায় বিশ্বনিন্দা অতটা ফুটে ওঠেনি অবশ্য। সুতরাং ওর ওপরই চাপানো যাক আর একটু রং। কানের লতিতেও একটু রং বুলিয়ে দেয় সেই সঙ্গে–সজীবতর করে তোলার জন্যে।