লড়াইয়ের দুটো দিকই কিন্তু খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে ক্যাপটেন। কুয়াশায় আবছা ভোরের রোদে ঝকমকে শিশির-ছাওয়া প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছে কনিং-টাওয়ারের মাথা উঁচিয়ে। ট্রেঞ্চে ট্রেঞ্চে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা, প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে হতভম্ব সৈন্যরা। আছড়ে পড়ছে কাতারে কাতারে। ভেঙেচুরে কাত হয়ে রয়েছে কামান আর বন্দুক, বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে যুদ্ধবন্দিরা। অপরূপ এই দৃশ্য দেখেই মাথা নামিয়ে নিয়ে ইশারায় হুকুম দিচ্ছে ক্যাপটেন। কখনও অর্ধেক গতিবেগে যেতে, কখনও সিকি গতিবেগ গড়িয়ে যেতে, কখনও ডানদিকে আধাআধি ঘুরে যেতে–এইরকম অজস্র হুকুম শুধু হাত আর মুখের ইশারায় বুঝিয়ে দিচ্ছে ম্যাড়মেড়ে আলোয় আলোকিত ইঞ্জিনকক্ষের তেলগন্ধী গোধূলি আলোয়। দুপাশে রয়েছে। দুটো কথা বলার নল। মাঝে মাঝে মাউথপিসে মুখ লাগিয়ে অদ্ভুত যন্ত্রযানের দুপ্রান্তের সহযোগীদের জানিয়ে দিচ্ছে, কখন কোন বন্দুকধারীদের ওপর পুরোদমে আক্রমণ চালাতে হবে, অথবা ডানদিকের ট্রেঞ্চটাকে কীভাবে শখানেক গজ দূর থেকে কাটিয়ে যেতে হবে। বয়সে সে নেহাতই তরুণ। রোদে পোড়া নয় মোটেই। আকৃতি আর ভাবসাব দেখে মনে হয় না কোনওকালে ট্রেনিং পেয়েছে রাজকীয় নৌবহরে। তা সত্ত্বেও কিন্তু বেশ সতর্ক, বুদ্ধিদীপ্ত এবং শান্ত। শুধু ক্যাপটেনই নয়–রাইফেলধারী আর ইঞ্জিনিয়ারদের প্রত্যেকেই ধীরস্থির মস্তিষ্কে তন্ময় হয়ে রয়েছে যে যার কাজ নিয়ে। শৌর্যবীর্য দেখাতে গেলে নাকি ক্ষিপ্তের মতো আচরণ করতে হয়, রক্তবহা নালির ওপর অত্যধিক চাপ দিতে হয়। হুটোপাটি করে চারপাশ গরম করে তুলতে হয়। কিন্তু অদ্ভুত এই যন্ত্রযানের ভেতরকার কোনও মানুষটিই এই ধরনের বিকট পাগলামি আর উৎকট বীরত্ব দেখাচ্ছে না।
উলটে অসীম অনুকম্পা থমথম করছে প্রত্যেকের অন্তরে। যাদেরকে মারতে হচ্ছে নিষ্ঠুরভাবে–অনুকম্পা হচ্ছে তাদের জন্যে। বুদ্ধিহীন পাশব শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে ওই যে জোয়ানরা একে একে লুটিয়ে পড়ছে গুলিবিদ্ধ হয়ে, ওরাও তো এদেরই মতো নওজোয়ান। কিন্তু মেশিন বানিয়ে লড়বার মতো বুদ্ধি নেই কারওই। কল্পনার অভাব থাকলে যা হয় আর কী। ক্যাপটেনও মনে মনে ভাবছে, আহা রে, লড়তেই যদি এলি, মাথা খাটিয়ে মানুষের মতো লড়লি না কেন? এ যে নিরেট গর্দভের মতো লড়াই। অনুকম্পার সঙ্গে তাই মিশে যাচ্ছে তাচ্ছিল্য। সেই সঙ্গে অনুতাপ। মানুষ মারার এই অভিনব যন্ত্র বানানোর জন্য অনুতাপ। যুদ্ধ নামক এই বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপারটা না ঘটালেই কি চলত না? এই নরমেধ যজ্ঞটা তো তাহলে এড়িয়ে যাওয়া যেত।
ওদিকে দক্ষ কেরানিদের মতো যান্ত্রিক নিষ্ঠায় মুণ্ডি ঘুরিয়ে বোম টিপে চলেছে রাইফেলধারীরা…
তিন নম্বর স্থলচর লৌহবর্মদেহীর ক্যাপটেন গোলন্দাজবাহিনীকে বন্দি করে ফেলে দাঁড় করিয়ে রেখেছে যন্ত্রযানকে। কনিং-টাওয়ার থেকে বিজয়গৌরবে দেখছে, সাইকেলবাহিনী ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে যুদ্ধবন্দিদের ঘিরে ফেলতে৷
চোখে পড়ল জেনারেলের সংকেত। কোন যন্ত্রযানকে কোথায় দাঁড়াতে হবে, কী করতে হবে–সেই সংকেত দিয়ে যাচ্ছে জেনারেল। ছোট্ট দুঃসংবাদটাও জানল সেই সংকেত থেকে। দশ নম্বর যন্ত্রযান জখম হয়ে পড়ে আছে। তবে মেরামত করে নেওয়া যাবে।
মই বেয়ে এসে খবরটা দিলে ইঞ্জিনিয়ারদের। একটা যন্ত্রযান কুপোকাত হয়েছে। সাময়িকভাবে, কিন্তু দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বাকি তেরোটা। যুদ্ধ জয়ের সমাপ্তি টানবে এই তেরোটাই।
দূর থেকে সারি সারি তেরোটা যন্ত্রযানের মাথায় বিজয়সূচক পতাকা আন্দোলন দেখতে পেল সাংবাদিক–অভিনন্দন জানাচ্ছে পরস্পরকে। ভোরের সোনালি রোদে সোনার মতো চকচকে করছে কালান্তক যমদূতের মতো যন্ত্রযানদের গা-গুলো।
.
০৫.
দৌড়াতে দৌড়াতে পায়ে ফোঁসকা পড়ে গিয়েছিল বেচারি সাংবাদিকের। ঘোড়া একটা জুটিয়েছিল, কিন্তু কিছু দূর টগবগিয়ে যাওয়ার পর গুলি খেয়ে এমন ল্যাংচাতে লাগল যে, রিভলভারের গুলিতে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছিল সাংবাদিক। পেছন ফিরে দেখছিল, সাইকেলে চেপে শহরবাসীরা বন্দি করছে সৈন্যদের নেহাতই আনাড়িভাবে। ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছে অপটু হাতে। ওই মাঝে সাইকেল আরোহীদের দিকে বন্দুক ছুঁড়তে ছুঁড়তে যারা এগচ্ছে, চলমান মেশিন নিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণে কুপোকাত হচ্ছে তারা।
অতএব আত্মসমর্পণ করাই ভালো। পকেট থেকে সাদা রুমালও বার করেছিল সাংবাদিক। তারপরে কানে ভেসে এল অশ্বারোহীদের খটাখট শব্দ। ছুটে যাচ্ছে নদীর ওপর সাঁকোর দিকে। রুমালখানা পকেটে পুরে পেছন পেছন দৌড়েছিল সাংবাদিকমশায়। কিন্তু দূর থেকেই দু-দুটো লৌহদানবকে সাঁকোর দুপাশে হিমশীতল দেহে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ের চোটে হিম হয়ে এল হাত-পা। প্রশান্ত ভঙ্গিমায় সাঁকো পাহারা দিচ্ছে দু-দুটো মেশিন–এদিকে দুমাইলের মধ্যে আসে কার সাধ্যি? পুরো মিত্রপক্ষকে ঘিরে ফেলেছে চৌদ্দটা লোহার কচ্ছপ-নিখুঁত নৈপুণ্যে।
অতএব আত্মসমর্পণই করতে হল। সার বেঁধে সৈন্যরা চলেছে অত্যন্ত লজ্জাকরভাবে এই কর্মটিই সম্পাদন করতে। গজগজ করছে তা সত্ত্বেও–ছা ছ্যা, এই কি লড়াই! চলমান বন্দুক নিয়ে মেশিনে চেপে লড়াই! হাতাহাতি লড়াইয়ের মুরদ নেই–