বিস্ফারিত চোখে অপূর্ব সেই যুদ্ধদৃশ্য দেখে প্রথমটা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল রণ-সাংবাদিক মশায়। তারপরেই যখন দেখল, মরা আর আধমরার স্থূপে মাত্র জনা ছয়েক গোলন্দাজ দাঁড়িয়ে, হাড়ে হাড়ে বুঝল খেল খতম! যুদ্ধ শেষ!
আত্মসমর্পণ করাটা কি ঠিক হবে? ভাবল রণ-সাংবাদিক। ধরা দিলে প্রতিবেদন আর পাঠানো যাবে না। পালানোই যাক বরং!
সংকীর্ণ গলিপথ বেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াল সাংবাদিক সাহেব ঘোড়ার সন্ধানে।
.
০৪.
স্থলচর লৌহবর্মদেহীরা নাকি তেমন অজেয় ছিল না–ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল অনেক পরবর্তীকালে এই ধরনের মতামত শোনা গিয়েছিল কর্তৃপক্ষমহলে। কিন্তু প্রথম আবির্ভাবের সেই দিনটিতে তাদের ক্ষমতা যে কতখানি ধ্বংসাত্মক হতে পারে, তা মহাশ্মশান সৃষ্টি করে দেখিয়ে দিয়েছিল অতি অল্প সময়ের মধ্যে।
দীর্ঘ, সরু তাদের বপু। আগাগোড়া অত্যন্ত মজবুত ইস্পাত ফ্রেমে ঢাকা ইঞ্জিন। তলায় আটজোড়া পা ঝুলছে খাঁজকাটা চাকা থেকে। একটিমাত্র মূল অক্ষরেখার দুদিকে যাতে এই আটজোড়া পা যেদিকে খুশি চালানো যায়–সেইভাবে লাগানো অ্যাক্সেল বা দণ্ড–চাকা আর পা ঝুলছে এই আটটি অ্যাক্সেল থেকে। মাটির অবস্থা যা-ই থাকুক-না কেন, বন্ধুর অথবা চেটালো–আটজোড়া পা সব অবস্থাতেই মানিয়ে নিতে সক্ষম। টিলায় ওঠার সময়ে কিছু পা রেখেছে পেছনের গর্তে, কিছু পা সামনের ঢালু জমিতে। কখনও কাত হয়ে। থেকেছে গর্তে পড়েও কিন্তু ভারসাম্য হারায়নি একবারওঃ ইঞ্জিনিয়াররা ইঞ্জিন চালিয়েছে। ক্যাপটেনের হুকুমে। ক্যাপটেন সারি সারি পোর্টহোল দিয়ে নজর রেখেছে চারদিকে। ওপরদিকের বারো ইঞ্চি পুরু লোহার চাদরের ঘাগরা ওঠানো-নামানো যায় ইচ্ছেমতো। পুরো বর্মদেহীকে ঘিরে রেখে দিয়েছে এই মজবুত লোহার পাত। ছোট গবাক্ষগুলো ছিল ঘাগরার দিকে। পুরো মেশিনটাকে সুরক্ষিত রেখেছিল এই ঘাগরা। ঘাগরার ওপরে ছিল একটা কনিং-টাওয়ার–যে জিনিসটা থাকে যুদ্ধজাহাজে–অস্ত্রশস্ত্রে সাজানো এইখানেই দাঁড়িয়ে জাহাজ পরিচালনা এবং পর্যবেক্ষণ–দুটো কাজই একসঙ্গে চালায় ক্যাপটেন। কালো বর্মাবৃতদের কনিং-টাওয়ার ইচ্ছেমতো ওঠাতে-নামাতে পারত ক্যাপটেন। মাঝের একটা লোহার ঢাকনির মধ্যে দিয়ে উঠে আসত কনিং-টাওয়ার, পোর্টহোল সমেত আবার নেমে যেত নিচে। আজব মেশিনের সামনে-পেছনে ডাইনে-বাঁয়ে ঝুলন্ত চেয়ারের মতো ঝুলছিল সারি সারি ক্ষুদ্র কক্ষ-অদ্ভুত গড়নের কক্ষ-রাইফেলধারীরা নিশ্চিন্ত নিরাপদে বসে ছিল সেখানে। রাইফেলগুলো অবশ্য হানাদারবাহিনীর রাইফেলের মতো মামুলি নয়– বিশেষ ধরনের।
প্রতিটি রাইফেলই অটোমেটিক। কার্তুজ বেরিয়ে যাচ্ছে, খালি জায়গায় নতুন কার্তুজ চলে আসছে কার্তুজমালা থেকে আপনা হতেই হাত দিয়ে ভরতে হচ্ছে না–কার্তুজের স্টক শেষ না-হওয়া পর্যন্ত অটোমেটিক রাইফেল তাই গুলিবর্ষণ করে চলেছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে। লক্ষ্যবস্তুর দিকে তাক করার জন্যেও রাইফেলধারীকে চোখের ব্যবহার করতে হচ্ছে না। ক্যামেরার ছবি ভাসছে যেন চোখের সামনে। দুটো আড়াআড়ি লাইন রয়েছে সেই ছবির মাঝে। লাইন দুটো যেখানে কাটাকুটি করেছে, ঠিক সেই বিন্দুটিতে যে ছবিটি এসে পড়ছে, অটোমেটিক রাইফেলের গুলি ছুটে যাচ্ছে নির্ভুল লক্ষ্যে সেইদিকেই। মৌলিকতা আছে বটে দর্শনব্যবস্থায়। নকশা-আঁকিয়ে ড্রাফটসম্যানের কম্পাসের মতো অথচ রীতিমতো জটিল একটা কম্পাস হাতে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাইফেলধারী। যে মানুষটাকে মারতে চায়, মোটামুটি তার উচ্চতায় খুলছে আর বন্ধ করছে। কম্পাসখানা। কম্পাস খুলে গেলেই খুলে যাচ্ছে ক্যামেরা ভিউ-বন্ধ করলেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দর্শনব্যবস্থা। কুয়াশার জন্যে দৃশ্য যাতে ঝাপসা না দেখায়, তার ব্যবস্থাও আছে আবহাওয়া বিশারদদের তারের বাজনার মতো একটা যন্ত্র দিয়ে–লৌহবর্মদেহী অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শনযন্ত্র ও সাময়িকভাবে স্থানবদল করে সুস্পষ্ট দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছে ক্যামরা ভিউতে। গাঢ় আঁধারে ভরা কক্ষে দাঁড়িয়ে সামনের সমুজ্জ্বল এই ছবির ওপর নজর রেখেছে রাইফেলধারী। দূরত্ব বিচারের জন্য এক হাতে রয়েছে কম্পাস, আর এক হাত রয়েছে দরজার হাতলের মতো একটা গোল মুণ্ডির ওপর। মুণ্ডি ঠেলে দিলেই দুলে উঠছে রাইফেল–চঞ্চল হয়ে উঠছে সামনের ছবি। যে মানুষটার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে বলে ঠিক করে ফেলেছে রাইফেলধারী, তাকে কাটাকুটি লাইনের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে এনে ফেলেই টিপে দিচ্ছে মুণ্ডির মাঝখানে ছোট্ট একটা বোতাম। অনেকটা বৈদ্যুতিক ঘণ্টার বোতাম। টেপার মতো। কদাচিৎ লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে মুণ্ডিটা ঈষৎ সরিয়ে মানুষটার উচ্চতায় কম্পাস ছোটবড় করে নিয়ে আবার টিপে দিচ্ছে বোতামটা–দ্বিতীয়বারে গুলি আর ফসকাচ্ছে না।
স্থলচর লৌহবর্মধারীর দুর্ভেদ্য আবরণের গায়ে রয়েছে তিন সারি গোলাকার গবাক্ষ। প্রত্যেকটা পোর্টহোলেই দেখা যাচ্ছে রাইফেলের নল আর দর্শনযন্ত্র। দৈবাৎ ক্যামেরা-বাক্সে দাঁড়িয়ে রাইফেলধারী ধুত্তোর! বলে জখম হওয়া যন্ত্র নামিয়ে নিয়ে মেরামত করে নিচ্ছে, অথবা বেশি জখম হলে নতুন যন্ত্র বসিয়ে দিচ্ছে।
সারি সারি এই ক্যামেরা-কেবিনগুলো কিন্তু ঝুলছে মূল অ্যাক্সেলের বাইরে–ঘুরন্ত চাকা থেকে ঝুলন্ত হাতির পায়ের মতো, মাটিতে একেবারেই ঠেকছে না। কেবিনের পেছনে রয়েছে একটা টানা লম্বা অলিন্দ-দানবটার সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত। বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতিতে ঠাসা রয়েছে এই করিডর। দানব মেশিনের জঠর বলতে একটাই-কলকবজায় ঠাসা বিরাট উদর। বেশ কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার চালাচ্ছে কলকবজা। ঠিক মাঝখানে, কনিং টাওয়ারের তলায় ক্যাপটেন দাঁড়িয়ে আছে একটা মইয়ের গোড়ায়। মই বেয়ে উঠে যেতে পারে কনিং-টাওয়ারে যে কোনও মুহূর্তে। যাচ্ছেও। একটা চাকা ঘোরালেই কনিং-টাওয়ার উঠে যাচ্ছে ওপরে–সেই সঙ্গে ক্যাপটেন। তখন তার কোমর পর্যন্তই কেবল দেখতে পাচ্ছে ইঞ্জিনিয়াররা। দুটিমাত্র বৈদ্যুতিক আলো রয়েছে করিডরে–প্রতিটি যন্ত্রপাতি কিন্তু দেখা যাচ্ছে সুস্পষ্ট। তেল আর পেট্রোলের গন্ধে কটু বাতাস। বাইরের খোলামেলা দুনিয়া থেকে। সহসা এই বদ্ধ পরিসরে আবির্ভূত হলে সাংবাদিকমশায়ের মনে হত, বুঝি বা এসে পড়েছে অন্য কোনও জগতে।