বীরত্ব দেখাচ্ছিল যে, গুলিটি অত দূর থেকে নিক্ষিপ্ত হল যেন ঠিক তার মাথার খুলি লক্ষ্য করেই।
দেখেই বীরত্ব উবে গেল অনেকের। ভয়ের চোটে মাথা নামিয়ে নিল বেশ কয়েকজন গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখল বাকি কজন মরিয়া সৈনিক।
তাতে বয়ে গেল করাল দৈত্যের। বিশাল বপু ট্রেঞ্চের পাড়ে তুলে নিতে লাগল আস্তে আস্তে–সিসের বুলেটগুলো যেন সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে গায়ে–ভাবখানা এইরকম।
উঠে এসেছে সামনের দিকটা–পেছনের পা-গুলো যেন পাড় আঁকড়ে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অচিরেই জমি কামড়ে দাঁড়িয়ে গেল খুদে বেঁটেখাটো পা-গুলো।
আস্তে আস্তে শম্বুকগতিতে পেরিয়ে এল ট্রেঞ্চ–পুরো দেহটা উঠে এল এপারে।
দাঁড়াল ক্ষণেকের জন্যে। ক্ষণিক বিরতি। সেই ফাঁকে সামলেসুমলে নিল ঘাগরা। মানে, মাটির খুব কাছেই নেমে এল ঘাগরা। রক্ত হিম-করা টুট টুট আওয়াজ করেই আচমকা ঘণ্টায় প্রায় ছমাইল বেগে ঢাল বেয়ে উঠে এল সাংবাদিক যেখানে চক্ষু স্থির করে বসে রয়েছে–সেইদিকে।
এরপরেও গুলিবর্ষণ চলেছিল কিছুক্ষণ। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে সরে পড়ল বন্দুকবাজরা। বুদ্ধিমানের মতো সাংবাদিকমশায়ও আর্টিস্টকে টানতে টানতে পালিয়ে এল মূর্তিমান যমদূতের সামনে থেকে।
ছুটল পাগলের মতো। আর্টিস্টমশায় যে আর কাছে নেই, সে খেয়ালও রইল। ক্ষণেকের জন্যে দেখেছিল যেন ডজনখানেক অতিকায় আরশোলা তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিপুল সৈন্যবাহিনীকে। তারপরেই টিলার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল সেই দৃশ্য। শুধু দেখল, সংকীর্ণ পথ বেয়ে হড়োহুড়ি করে পালাচ্ছে বীরপুংগবরা। এক-আধজন ওরই মাঝে দাঁড়িয়ে গিয়ে দু-একবার রাইফেল ছুঁড়েই আবার ঠেলাঠেলি করে দৌড়াচ্ছে সামনে। যেতে যেতেই শুনল, দ্বিতীয় সারির ট্রেঞ্চও নাকি হাতছাড়া হয়ে গেছে একটিমাত্র দানবের আবির্ভাবে!
ঠিক এই সময়ে পাশের লোকটি হাত-পা ছুঁড়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে! দানবের গুলিবর্ষণ আরম্ভ হয়েছে এদিকেও!
ক্ষিপ্তের মতো ছুটল সাংবাদিক–কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে, কর্তব্যবিস্মৃত হয়ে, মারপিট করে এগিয়ে চলল দানবের খপ্পরের বাইরে–নিরাপদ অঞ্চলের দিকে। অনেকখানি পথ এইভাবে এসে দম নেবার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিল সাংবাদিক।
রাত বিদায় নিয়েছে–দিনের আলোয় উদ্ভাসিত চারদিক। ধূসর আকাশ আর ধূসর নেই –গাঢ় নীল। মেষলোমের মতো সামান্য মেঘ ভাসছে হেথায় সেথায়। সমুজ্জ্বল ধরণিতলে কিন্তু চলছে প্রলয়ংকর কাণ্ডকারখানা। উত্তরের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ। কামান-টামান ছেড়েই পালাচ্ছে। দক্ষিণে দেখা যাচ্ছে চৌদ্দটা লোহার কচ্ছপকে। মানুষের গতিবেগেই তাড়িয়ে আনছে পলায়মান বীরপুরুষদের থেকে থেকে গর্জে উঠছে রাইফেল–নির্ভুল লক্ষ্যে ধরাশায়ী করছে এক-একজনকে। লোহার কচ্ছপ তিরিশ ফুট চওড়া ট্রেঞ্চ পেরিয়ে যাচ্ছে অবলীলাক্রমে। লোহার কচ্ছপ–কিন্তু আকারে দানবিক এবং ছুটছে মানুষের গতিবেগে। কামানের গোলা আর রাইফেলের বুলেটকে ভ্রূক্ষেপ করছে না। অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে নিষ্ঠাসহকারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে বিরামবিহীনভাবে। মেশিন! মানুষকে পায়ের তলায় পিষে যাচ্ছে মেশিন!
ভোর সাড়ে চারটে। মাত্র দুঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ।
উত্তরে দেখা দিয়েছে শত্রুপক্ষের সাইকেলবাহিনী। তিলমাত্র হুটোপাটি নেই। ধীরগতিতে ঘেরাও করে ফেলছে ছত্রভঙ্গ সৈন্যদের।
যুদ্ধ শেষ! মাত্র দুঘণ্টার মধ্যে।
মাত্র তিনশো গজ দূরে একটা লৌহবর্মদেহীকে তেরচাভাবে তারই দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই পাঁইপাঁই করে দৌড়াল সাংবাদিক! দাঁড়িয়ে গেল পরক্ষণেই মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ শুনে–শব্দ আসছে বাঁদিক থেকে। দেখাই যাক-না দৃশ্যটা।
.
০৩.
লৌহবর্মদেহীরা চড়াও না-হওয়া পর্যন্ত বন্দুক নিয়ে আর কারদানি দেখাতে যায়নি মিত্রপক্ষ। গুলি চালাবে কাদের ওপর? নিজেদেরই হতাহত সৈন্যদের ওপর? দ্বিতীয় সারির ট্রেঞ্চও তো হাতছাড়া। স্থলচর লৌহবর্মদেহীদের অগ্রগতি এখন আগের চাইতের দ্রুততর। বাধা তেমন নেই। বাধা যেখানে, নির্ভুল লক্ষ্যে গুলিবর্ষণ ঘটছে ঠিক সেইখানেই। পলায়মান পদাতিকবাহিনী নিয়ে নতুন রণকৌশলের কথা ভাবতে লাগল মিত্রপক্ষের জেনারেল। মতলবটা ঠিক করতে হবে আধ ঘণ্টার মধ্যেই। এর মধ্যে চলুক কামান আর বন্দুকবর্ষণ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেল, তা দায়সারা গোছের হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
রুখে দাঁড়িয়েছিল তিনটে গোলন্দাজবাহিনী। সাজসরঞ্জামসহ কামান নিয়ে বীরদর্পে মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করে গিয়েছিল আগুয়ান লৌহদানবকে লক্ষ্য করে। বাঁদিকে এগিয়ে আসছিল তিনটে কালো মেশিন–ডানদিকে একটা। বাঁদিকের তিনটে মেশিনের ওপর গোলা আছড়ে পড়ছিল অবিশ্রান্ত ধারায়–কিন্তু মেশিন তিনটে কামান-টামানের দিকে তেড়ে না গিয়ে এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেখান থেকে কামান যারা চালাচ্ছে, তাদেরকে গুলিবর্ষণের আওতায় আনা যায়। তারপরেই পাশের দিক থেকে মাঝে মাঝে ছুটে আসছিল একটা বুলেট–কামানে যে হাত দিতে যাচ্ছে, ঠিক তারই মাথার খুলি লক্ষ্য করে। দেখতে দেখতে বিপর্যস্ত হয়ে গেল সেদিককার গোলন্দাজবাহিনী। বেশ কিছু কামান থেকে কোনও গোলাবর্ষণই ঘটল না।
ডানদিকের একটি মেশিন সহসা টানা লম্বা পাশের দিকটা ঘুরিয়ে দাঁড়াল কামানবাহিনীর দিকে, তারপর শুরু হল নির্ভুল গুলিবর্ষণ। মাত্র চল্লিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে বিশাল কালো দৈত্য ভলকে ভলকে উগরে গেল অগ্নিঝলক–প্রতিটি বুলেট ধরাশায়ী করছে এক-একজন গোলন্দাজ- কে।