বলে-টলে, নরম মাটির গাদায় দশ আঙুল গেঁথে ধরে, কষে চোখ বন্ধ করে ছিল ফোদারিনগে এবং চেঁচিয়ে উঠেছিল বাজখাঁই গলায়, চালাও!
নিস্তব্ধ নিথর হয়ে গিয়েছিল বিশ্বচরাচর। থমথমে নৈঃশব্দ্য। উঁচ পড়লেও যেন ওইটুকু আওয়াজও শোনা যাবে–এমনি স্তব্ধতা। চোখ-বন্ধ অবস্থাতেই ফোদারিনগে টের পেয়েছিল, দাঁড়িয়ে আছে সে দুপায়ে ভর দিয়ে খাড়া অবস্থায়।
কানে ভেসে এসেছিল উদাসীন কণ্ঠস্বর, তা যা বলেছ!
চোখ খুলেছিল ফোদারিনগে।
দাঁড়িয়ে আছে লং ড্রাগন পানশালায়। মির্যাকল প্রসঙ্গ নিয়ে তুলকালাম কথা কাটাকাটি চলছে টোডি বিমিসের সঙ্গে। আবছা একটা অনুভূতি জাগ্রত রয়েছে মাথার মধ্যে–কী যেন চকিতে ধেয়ে গিয়েছে চেতনার ওপর দিয়ে। কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা। মির্যাকূল ঘটানোর ক্ষমতাটাই কেবল হারিয়েছে ফোদারিনগে–ফিরে পেয়েছে। আর সবকিছুই। যা ছিল, তা-ই হয়ে গেছে। এ গল্প শুরু হওয়ার সময়ে ওর মন আর স্মৃতি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল–এখনও রয়েছে সেখানেই। কাজেই যা কিছু বলা হল এইমাত্র এবং যা কিছু বলা হচ্ছে আজ পর্যন্ত, তার বিন্দুবিসর্গ ওর জানা নেই। তার চাইতেও বড় কথা, মিরাকল জিনিসটাতে আজও ওর বিশ্বাস নেই তিলমাত্র৷
তা যা বলেছ, বলে বাঁকা হেসে চেয়ে রইল টোডি বিমিস।
জিনিসটা আগে ভালো করে বোঝ, তেড়েমেড়ে বলেছিল ফোদারিনগে, মির্যাল হল এমনই সব উদ্ভট আজগুবি ব্যাপারস্যাপার, যা নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক ব্যাপারস্যাপারের ঠিক উলটো, ইচ্ছাশক্তির জোরে যে অঘটন ঘটানো চলে…।
অদ্ভুত অর্কিড
অদ্ভুত অর্কিড ( The Flowering of the Strange Orchid)
[‘The Flowering of the Strange Orchid’ ১৮৯৪ সালের আগস্ট মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। ‘Pearsons Magazine’ পত্রিকায়। ১৮৯৫ সালে লন্ডনের ‘Methuen & Co.’ থেকে প্রকাশিত ওয়েলসের প্রথম ছোটগল্পের ‘The Stolen Bacillus and Other Incidents’-তে গল্পটি স্থান পায়।]
অর্কিড এমনই একটা ফুল, যা কেনার জন্যে পাগল হতে হয়, কেনার পরেও পাগল হয়ে থাকতে হয়। একটু একটু করে পাপড়ি মেলে ধরে ফুল যতই ফুটতে থাকে, রং আর শোভা ততই মনকে মাতাল করে দেয়। নব নব আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে হয়।
এ নেশা পেয়ে বসেছিল ওয়েদারবার্নকেও। অর্কিড় জমানোর বাতিক তাকে নিত্যনতুন উত্তেজনার খোরাক জুগিয়ে গেছে। সারাজীবনটাই তার উত্তেজনাবিহীন। চৌকস মানুষ মোটেই নয়। লাজুক। নিঃসঙ্গ। পয়সাকড়ি যা আছে, তাতে প্রয়োজন মিটে যায়, কিন্তু এমন উদ্যম নেই যে, চাকরিবাকরি জুটিয়ে নেয়। ডাকটিকিট জমানো, হোরেস অনুবাদ, বাঁধানো বই কেনা, ডায়াটমের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার–এইসব করেই সময় কাটালে পারত। কিন্তু পেয়ে বসল অর্কিড় জমানোর বাতিকে। ছোট্ট একটা হট-হাউস বানিয়ে নিয়েছে নিজেই। কাচের ছাদওয়ালা উষ্ণ গৃহ। গাছপালা পরিবর্ধন আর ফল পাকানোর মোক্ষম ব্যবস্থা।
সকালবেলা কফি খেতে খেতে গল্প হচ্ছে গৃহকত্রীর সঙ্গে। মেয়েটি তার খুড়তুতো বোনও বটে। স্বভাবে ভাইয়ের ঠিক বিপরীত। ঘরসংসার নিয়ে দিব্যি আছে। খামকা উত্তেজনার পেছনে দৌড়াতে চায় না।
কিন্তু গজগজ করে চলেছে ওয়েদারবার্ন। সারাজীবনটাই তার কেমন ভিজে-ভিজে। অন্য লোকদের জীবনে কত রকমের বৈচিত্র, কত অ্যাডভেঞ্চার, কত বিপদ ঘটে। কিন্তু তার জীবনটা ছেলেবেলা থেকেই বড় একঘেয়ে, শৈশবে পড়তে হয়নি প্রেমে–ফলে, বিয়ে থা-ই হল না। অথচ ওই যে হার্ভে–সোমবারে কুড়িয়ে পেল ছপেনি মুদ্রা, বুধবারে টলতে লাগল সমস্ত মুরগিছানা, শুক্রবারে অস্ট্রেলিয়া থেকে এল খুড়তুতো ভাই, শনিবারে ভাঙল গোড়ালি! অহো! অহো! উত্তেজনার এহেন ঘূর্ণিঝড়ে ওয়েদারবার্নকে কখনও পড়তে হয়নি। এর চাইতে পরিতাপের বিষয় আর হয় কি? তবে হ্যাঁ, কফির দ্বিতীয় কাপে ধীরেসুস্থে চুমুক দিতে দিতে বলেছিল ওয়েদারবার্ন–আজ একটা নতুন কিছু ঘটবে মনে হচ্ছে। কেন না, আজ সে যাচ্ছে আন্দামান আর ইন্ডিজ থেকে আনা কিছু উদ্ভিদ কিনতে।
যার কথা সেদিন তুমি বলছিলে? প্রশান্ত কণ্ঠে বলেছিল বোন।
হ্যাঁ। তাই অর্কিড বেচে দিচ্ছে পিটার দোকানদার।
অর্কিড জমানোর বিষম বাতিক ছিল বুঝি?
সাংঘাতিক। অথচ বয়সে আমার চাইতে তেইশ বছরের ছোট। মোটে ছত্রিশ, এই বয়সের কতরকম উত্তেজনা যে পেয়েছে, তার হিসেব নেই। মারা গেল উত্তেজনা কুড়াতে কুড়াতেই। বিয়ে করেছিল দুবার, বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছিল একবার। ম্যালেরিয়ায় ভুগিয়েছিল চারবার। ঊরুর হাড় ভেঙেছিল একবার। একবার একটা মালয়বাসীকে খুন করেছিল নিজের হাতে, নিজেই একবার জখম হয়েছিল বিষাক্ত তিরে। শেষকালে মারা গেল জঙ্গলের জোঁকের পাল্লায় পড়ে–শুধু এই জোঁকের ব্যাপারটা ছাড়া বাদবাকি সবই দারুণ ইন্টারেস্টিং, তা-ই না?
আমার কাছে নয়, বলেছিল বোন।
তা অবশ্য নয়। আটটা তেইশ বাজল। পৌনে বারোটায় ট্রেন। চললাম।
বাড়ি ফিরল ওয়েদারবার্ন বিষম উত্তেজনা নিয়ে। না বুঝেই কিনে ফেলেছে কিছু অর্কিড, উত্তেজনা সেই কারণেই। অজ্ঞাত অর্কিডের রহস্য বেশ মাতিয়ে তুলেছে তাকে।
ডিনার খেতে খেতে বোনকে বলছিল সেই কথাই। নিশ্চয় আশ্চর্য কিছু এর পর থেকে ঘটবেই। আজ থেকেই যে তার শুরু, সকালেই তা টের পেয়েছিল। কয়েকটা অর্কিডের নাম সে জানে। কিন্তু এই যে এই অর্কিডটা, প্যালিনোফিস হতে পারে, না-ও পারে, এক্কেবারে নতুন প্রজাতি অথবা একটা মহাজাতি হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু সেই। ব্যাটেন। বেচারা নাকি এই অর্কিডটাই সংগ্রহ করার পর মারা গিয়েছিল।