সরে গেল সার্চলাইটের আলো। আবার নিচ্ছিদ্র তমিস্রা। কিন্তু গোলন্দাজদের মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনেই বোঝা গেল, অদ্ভুত বিকট বস্তুটা এগিয়ে আসছে অবিচল গতিবেগে।
জিনিসটা আদতে কী, তা-ই নিয়ে একটু আলোচনা করতে গিয়েই আচমকা আর্টিস্টমশায়ের মুখে এসে পড়ল এক ঝাপটা ধুলো।
উড়ুক্কু বুলেট উড়িয়ে নিয়ে গেল এক চাকলা মাটি–তারই ধুলো!
আর-একটু হলেই উড়ে যেত খুলিটা। চট করে মাথা নামিয়ে নিল দুজনেই। গুঁড়ি মেরে সরে এল পেছনের ট্রেঞ্চে। সেখানে তখন জোর গুলতানি চলেছে হতভম্ব সৈন্যদের মধ্যে। মহাকায় বস্তুটার স্বরূপ ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ঠিকই, সামনের সারির সৈন্যসামন্তও এতক্ষণে পরলোকের টিকিট কেটে বসেছে নিশ্চয়–কিন্তু এখুনি তো ভোরের আলো ফুটবে। তখন একহাত নেওয়া যাবে বাছাধনদের।
বাছাধনদের মানে? দেখলাম তো একটাই, জানতে চায় সাংবাদিক।
লাইনবন্দি আসছে–পোকার মতো গুটিগুটি–আসুক না–আমরাও তৈরি!
এখনও তড়পানি? বাছাধন যাদের বলা হল, তাদের একটিকে দেখেই তো চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে সাংবাদিকের। আসছে নাকি লাইন দিয়ে। মোট কটা?
একগাল চকোলেট চেবাতে চেবাতে আবার উঁকি দিয়েছিল সাংবাদিক। অন্ধকার এখনও আছে বটে, কিন্তু একটু ফিকে হয়ে এসেছে। তরল অন্ধকারে শত্রু-দানবদের দেখা যাচ্ছে সারি সারি। চোদ্দো-পনেরোটা তো বটেই–একটা থেকে আর-একটার ব্যবধান তিনশো গজ। বদখত আকারের অতিকায় দানবরা প্রথম সারির ট্রেঞ্চ পেরিয়ে এসে নির্ভুল লক্ষ্যে গুলিবর্ষণ করছে যেখানে সৈন্যরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে–ঠিক সেইদিকেই।
অন্ধকার আরও ফিকে হয়ে আসছে। দূরবিনের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রথম সারির ট্রেঞ্চে মড়া আর আধমড়া ছাড়া কেউ নেই। দ্বিতীয় সারির ট্রেঞ্চের মাটির পাঁচিলের আড়ালে বসে রাইফেলধারীরা সমানে গুলিবর্ষণ করে চলেছে আগুয়ান লৌহবর্মাবৃতদের দিকে। সামনের দিক থেকে চম্পট দিয়েছে সৈন্যরা–সরে গেছে ডাইনে আর বাঁয়ে। গুলি ছুটে যাচ্ছে–ওই দুদিক থেকেই।
কাঠখোট্টা একজন করপোরাল দুরবিনটা ছিনিয়ে নিল সাংবাদিকের হাত থেকে। আজব লড়াই-দৃশ্য দেখে নিয়ে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল সেঁতো হাসি হেসে, বাছাধনরা আঁকাবাঁকা ট্রেঞ্চ পেরিয়ে এগুতেই পারবে না–আমাদের সৈন্যরা ওই ট্রেঞ্চ দিয়েই তো পিছু হটছে। একটু পরেই হাল ছেড়ে দিয়ে যেই পেছন ফিরবে, অমনি দমাদম গুলি চলবে পেছন থেকে।
গতিক কিন্তু সুবিধার মনে হল না সাংবাদিকের কাছে।
দিনের আলো ফুটছে একটু একটু করে। মেঘ উঠে যাচ্ছে, সোনালি রোদের আভা দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে স্থলচর বর্মদেহীদের। ঢালু জায়গায় কাত হয়ে রয়েছে একটা। লম্বায় আশি থেকে একশো ফুট তো বটেই। খাড়াই পাশটা মাটি থেকে ফুট দশেক পর্যন্ত বেশ মসৃণ–তারপরেই কচ্ছপের ঢাকনির মতো নকশাকাটা বর্ম দিয়ে ঢাকা ওপরের দিকটা। লম্বা মনে হলেও আসলে তা সারি সারি গোলাকার গবাক্ষ-রাইফেলের নয়, টেলিস্কোপের টিউব বেরিয়ে আছে অগুনতি পোর্টহোলের মধ্যে দিয়ে। কোনওটা নকল। কিন্তু এমন গায়ে গায়ে বসানো যে আসল-নকলে তফাত ধরে কার সাধ্যি। প্রায় আড়াইশো গজ দূরে এহেন বিকটাকৃতি বিদঘুটে লৌহদানব একটা ট্রেঞ্চ পেরিয়ে আসছে বিন্দুমাত্র তাড়াহুড়ো না করে। ট্রেঞ্চটা এখন শূন্য। লৌহদানবের আসার পথের দুপাশে কিন্তু স্তূপীকৃত মৃতদেহ-বুলেটবিদ্ধ নিশ্চয়। যে পথ দিয়ে সে এসেছে, সে পথে দেখা যাচ্ছে ফুটকি ফুটকি দাগ-বালির ওপর দিয়ে কাঁকড়া চলে গেলে যেরকম দাগ পড়ে–প্রায় সেইরকম।
ট্রেঞ্চের ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে উঠে আসছে অজানা আতঙ্ক।
কানের কাছে শোনা গেল সেই কাঠগোঁয়াড় করপোরালের আত্মম্ভরিতা–ভেতরে বসে যারা চালাচ্ছে, তাদের এইবার দেখে নেব।
নির্বোধ! মনে মনেই বলে সাংবাদিক।
প্রথম সারির ট্রেঞ্চ হাতছাড়া হয়ে গেল–এবার পালা দ্বিতীয় আর তৃতীয় সারির ট্রেঞ্চের।
আচমকা হাঁকার দিয়ে ওঠে করপোরাল। সঙ্গে সঙ্গে গুড়ম গুডুম শব্দে রাইফেলবর্ষণ আরম্ভ হয়ে যায় দুপাশে! বৃষ্টির মতো গুলি গিয়ে পড়ছে যার ওপর, সে কিন্তু এগিয়ে আসছে নির্বিকারভাবে। দানব… দানব… সাক্ষাৎ দানব! তপ্ত সিসের বুলেট তো নয় যেন লোহার চামড়ায় ছিটকে যাচ্ছে শিলাবৃষ্টি। ফটফট-ফট শব্দে এগচ্ছে তো এগচ্ছেই– পেছনে ফুড়ুক ফুড়ুক করে বেরচ্ছে বাষ্প। শামুক যেমন পিঠ কুঁজো করে নেয় এগনোর সময়ে, পিঠটা কুঁজো করে রয়েছে সেইভাবে। তুলে ধরেছে পরনের ঘাগরা–দেখা যাচ্ছে। পা!
হ্যাঁ, হ্যাঁ… সারি সারি পা! মোটা মোটা খাটো পা… গুলি আর বোতামে আচ্ছন্ন অজস্র পা। চ্যাপটা, চওড়া হাতির পা অথবা শুয়োপোকার পায়ের মতন। ঘাগরাটা আর-একটু তুলতেই চোখ কপালে উঠে গেল সাংবাদিকমশায়ের!
পা-গুলো ঝুলছে যেন চাকার গা থেকে!
দূরবিন কষে ভালো করে দেখল সাংবাদিক। না, চোখের ভুল নয়।
এই জিনিস যদি গুটুর গুটুর করে হেঁটে যায় ওয়েস্টমিনস্টারে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট বরাবর, তখন যা কাণ্ড ঘটবে, কল্পনা করতেই চুল খাড়া হয়ে যায় সাংবাদিকের।
কানের পাশে রাইফেল চালাচ্ছিল যে মহাবীর সৈনিকটি, অচম্বিতে একটা বুলেট উড়িয়ে নিয়ে গেল তার করোটি–ওদিকে ট্রেঞ্চের এপারে অনেকখানি উঠে এসেছে ভীমদর্শন বিভীষিকা।