চোখের ভুল।
উঁহু, বিরাট ছায়ার মতো কী যেন দুলে উঠল ওই গাছগুলোর মাথায়।
চোখের ভুল যে নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল অচিরেই। মিত্রপক্ষের কামান গর্জে উঠল –গোলা ছুটে গেল বিশেষ গাছগুলোকে লক্ষ্য করে।
পুঞ্জীভূত ছায়া-দানবকে দেখেছে তারাও।
কিন্তু সত্যিই কি সেটা দানব?
রহস্যের সমাধান ঘটল একটু পরেই পরেই–চক্ষুস্থির হয়ে গেল প্রতিটি পুঁদে সৈন্যের।
.
০২.
তরুণ লেফটেন্যান্ট খুব বড়াই করেছিল তার আগে। রণপরিচালনা যদি তার হাতে থাকত, তাহলে ভোরের অপেক্ষায় বসে থাকত না। হা-রে-রে-রে করে তেড়ে গিয়ে রাতের অন্ধকারেই দখল করত একটার পর একটা ট্রেঞ্চ।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটল অন্যরকম।
যে ট্রেঞ্চগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে হ্যাকবোক্স হাট, লড়াই শুরু হল ঠিক তার উলটোদিকে। সেদিকের জমি উঁচুনিচু নয়, দিব্যি চেটালো–বহু দূর বিস্তৃত তেপান্তরের মাঠ বললেই চলে–টিকটিকিরও লুকিয়ে থাকার জায়গা নেই। সদ্য ঘুম-ভাঙা মিত্রপক্ষ সেই দৃশ্য দেখে তো হেসেই খুন। সত্যিই ডাহা আনাড়ি বটে শত্রুপক্ষ!
আনাড়ি তো বটেই। যুদ্ধ কাকে বলে জানেই না! কিন্তু এইরকম একখানা হাস্যকর প্রমাণও যে আশা করা যায়নি।
রণ-সাংবাদিক তো হতভম্ব! স্বচক্ষে দেখেও বিশ্বাস করা যায় না এই দৃশ্য। রণক্ষেত্রের আর্টিস্টমশায় তখন চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসে সবে জুতোর ফিতে বাঁধছে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে। ভাবল বুঝি, ঘুমের ঘোর এখনও যায়নি। তাই এমন। উদ্ভট দৃশ্য দেখতে হচ্ছে।
ফাঁকা মাঠে তেড়ে আসছে শত্রুসৈন্য! এখনই তো মিত্রপক্ষের কামান-বন্দুক ঝড় বইয়ে দেবে–প্রাণে বেঁচে ফিরে যেতে হবে না একজনকেও! নাঃ, মাথায় এক বালতি জল ঢালা দরকার, তবে যদি চোখের ভ্রান্তি কাটে।
কিন্তু হড়হড় করে ঠান্ডা কনকনে জল ঢালার পরেও শোনা গেল অদ্ভুত একটা শব্দলহরি। যেন টিনের ব্রিজের ওপর দিয়ে এগিয়ে আসছে হাজার দশেক গোরুর গাড়ি!
মেশিনগান নিশ্চয়।
এক পায়ে জুতোর ফিতে বেঁধে, আরেক পায়ে তিড়িক তিড়িক করে লাফাতে লাফাতে ঘড়ি দেখল রণ-শিল্পী-রাত আড়াইটে।
আক্রমণ করার এই কি সময়? যুদ্ধবিদ্যা জানা নেই তো–তাই ভেবেছে, আচমকা রাতবিরেতে তেড়ে এসে চমকে দেবে হানাদারদের।
কিন্তু এরাও তো পাকা লড়াইবাজ। আচমকা ঘুম ভেঙে গেলেও তৈরি হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গে। এদিকে-ওদিকে দেখা যাচ্ছে ছুটন্ত লণ্ঠন–ট্রেঞ্চের দিকে দৌড়াচ্ছে সৈন্যরা।
তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এল রণ-সাংবাদিক–পেছন পেছন তাড়াহুড়ো করে বেরতে গিয়ে তাঁবুর দড়িতে পা আটকে মুখ থুবড়ে পড়ল বেচারি আর্টিস্টমশায়।
শত্রুরা তখন এলোপাথাড়ি সার্চলাইট ফেলছে। খুব একটা বীরত্ব দেখানো হচ্ছে যেন মিত্রপক্ষের চোখ ধাঁধিয়ে দেবে ভেবেছে নাকি?
চোখ ধাঁধিয়েই গেল অবশ্য দুজনের। আর-একটু হলেই পা ভাঙত সামনের খানায় পড়ে।
একটু এগতেই আচম্বিতে যেন একটা প্রচণ্ড রেল-দুর্ঘটনা ঘটল মাথার ওপর সেইরকমই ভীষণ আওয়াজ। এ্যাপনেল গোলা ফেটেছে মাথার ওপর–শিলাবৃষ্টির মতো গুলি ছুটে যাচ্ছে চারদিকে।
ডাইনে-বাঁয়ে সে কী হট্টগোল! গুলি চলছে দমাদম শব্দে–কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। প্রথম প্রথম এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণের পর নিয়মের মধ্যে এসে গেল ছোট ছোট স্ফুলিঙ্গর ছুটে যাওয়া। শত্রুপক্ষ বোধহয় পুরো বাহিনী নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ফলটা হবে চূড়ান্ত হয় হেরে ভূত হবে, নয় জিতে যাবে।
প্রথমদিকের সেই কানের পরদা-ফাটানো শব্দপরম্পরা কিন্তু কমে এল একটু একটু করে, ব্যাপার কী? মিত্রপক্ষ সাবাড় হয়ে গেল নাকি এর মধ্যেই?
মাইল দুয়েক দূরে মাঝে মাঝে গর্জে উঠছে শত্রুপক্ষের কামান–পূর্ব আর পশ্চিমে থেকে থেকে ধমক দিচ্ছে দু-একটা রাইফেল। প্রহেলিকার সমাধান করার আগেই আচমকা সার্চলাইটের প্রখর আলো এসে পড়ল দুজনের ওপর। সেই আলোয় দেখা গেল সামনের দৃশ্য–অনেক দূর পর্যন্ত। পাগলের মতো ট্রেঞ্চ লক্ষ্য করে ছুটছে সৈন্যরা একজন দুহাত মাথায় ওপর ছুঁড়ে আছড়ে পড়ল ধড়াস করে–আর নড়ল না। তার পেছনেই দেখা গেল বিশালকায় চকচকে কালো একটা বস্তু–তারও পেছনে প্রশান্ত সাদা চক্ষু মেলে সার্চলাইটটা নিরীক্ষণ করে চলেছে যুদ্ধ-পাগল দুনিয়াটাকে।
পরক্ষণেই একটা এ্যাপনেল গোলা ফাটল মাথার ওপর। আবার শিলাবৃষ্টির মতো বুলেট ঝরে পড়ল চারপাশে। মুখ গুঁজড়ে আছড়ে পড়ল সাংবাদিক আর শিল্পী।
পড়ল একটা ট্রেঞ্চের মধ্যেই। রুদ্ধশ্বাসে শুধায় সাংবাদিক, ব্যাপারটা কী? আমাদের লোকজন তো গুলি খেয়ে মরছে দেখছি।
গুলি তো করছে ওই কালো জিনিসটা। ঠিক যেন একটা কেল্লা। প্রথম ট্রেঞ্চ থেকে শদুই গজ দূর থেকে যা গুলি চালাচ্ছে… নিরেট পাথরের বাড়ি যেন, অথবা দানবের থালার ঢাকনা।
আহা রে, উপমার কী ছিরি!
যা-ই হোক, বিদঘুটে কিন্তু ভয়ংকর বস্তুটাকে তাহলে তো খুঁটিয়ে দেখা দরকার। প্রাণটা বেঘোরে যেতে পারে ঠিকই কিন্তু সাংবাদিকদের কর্তব্য করতে গেলে প্রাণের মায়া করলে চলে কি?
তাই ট্রেঞ্চ থেকে উঁকি দিতেই দুদিক থেকে দুটো সার্চলাইটের তীব্র আলোকবন্যার মধ্যে সুস্পষ্ট দেখা গেল আগুয়ান বিভীষিকাকে।
দুঃস্বপ্ন নাকি?
বিচিত্র বস্তুটাকে একটা সুবৃহৎ পোকা বলা চলে। লোহার বর্ম-আবৃত কীট। তেরচাভাবে। এগচ্ছে প্রথম সারির ট্রেঞ্চের দিকে। পাশের দিকে সারি সারি গোলাকার গবাক্ষ। গুলি ছুটে আসছে তাদের মধ্যে থেকে। অবিশ্রান্ত গুলি আছড়ে পড়ছে বর্মের ওপর–কিন্তু বৃথাই। টিনের চালায় আছড়ে পড়লে যেরকম ঝনঝন টংটং আওয়াজ শোনা যায়–শুধু সেই আওয়াজই হচ্ছে–প্রত্যেকটা গুলিই ঠিকরে বেরিয়ে যাচ্ছে বর্মে লেগে।