কিন্তু খিদের জ্বালা যে বড় জ্বালা। ইউদেনা তো আর আঘ-লোমির মতো শিকারি নয়। তাই চুরি করা ছাড়া আর করে কী বেচারি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চুরি। খাবার চুরি। ইউদেনাকে সিংহের আস্তানায় বেঁধে রেখে আসার পরের দিন সকালে পুরুষ যোদ্ধারা জঙ্গলে গিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে ধরে নিয়েছিল, আপদ গেছে সিংহের পেটে। কিন্তু রোজই এক ডেলা মাংস খুঁটির ডগায় গেঁথে রেখে আসত জঙ্গলের কিনারায় উয়ায়া সিংহের জন্যে। এই মাংসই চুরি করে এনে ভাগাভাগি করে খেত আঘ-লোমি আর ইউদো। কাঁচা মাংস অতিশয় বলকারক। দুদিনেই শক্তি ফিরে পেয়েছিল আঘ-লোমি। কিন্তু খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল বাকি জীবনের মতো।
কিন্তু রোজ রোজ চুপিসারে চুরি কি সম্ভব? একদিন ইউদোকে দেখেই আঁতকে উঠেছিল পুরুষ যোদ্ধারা। তারপরেই অবশ্য মার মার করে তেড়ে এসেছিল পেছন পেছন। কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। প্রস্তর-কুঠারের এক-এক কোপে এক-একজনকে ধরাশায়ী করেছিল খোঁড়া আঘ-লোমি। ইউদেনাও কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকেনি–এ যুগের মেয়েরা যা করে। হরিণের শিং ঘুরিয়ে জখম করেছিল বেশ কয়েকজনকে। জনা তিনেক পুরুষ যোদ্ধা প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল জঙ্গলে।
পুরুষশূন্য দলটার অধিপতি হয়ে বসেছিল আঘ-লোমি–বাহুবলে এবং শক্তিবলে। শুধু জিঘাংসা নয়, ক্ষমাও ছিল বইকী তার অন্তরে–যা এ যুগের মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না। জীবিত যোদ্ধা তিনজন পরে ফিরে এসেছিল–রোজ রোজ কাঁচা মাংস দূরে রেখে দূরেই বসে থাকত। একদিন মন নরম হল আঘ-লোমির। ক্ষমা করেছিল তিনজনকে।
দীর্ঘদিন দলপতি ছিল সে। তারপর বুড়ো হলে তার জায়গায় এসেছিল আর-একজন।
পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে চলছে এই একই কাণ্ড। সভ্যতা এগিয়ে চলেছে শনৈঃ শনৈঃ।
————
[অনুবাদক: ওয়েলস এই বৃহৎ গল্পটি লেখেন ১৮৯৯-তে। এডগার রাইস বারোজ টারজানের জঙ্গল অ্যাডভেঞ্চারের প্রথম কাহিনি লেখেন ১৯১৪-তে। টারজানের গল্প আজ অধিকতর জনপ্রিয়। ওয়েলসের গল্পটি সংক্ষেপিত করা হল জঙ্গল অ্যাডভেঞ্চারের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে।]
লোহার কচ্ছপ
লোহার কচ্ছপ ( The Land Ironclads )
[‘The Land Ironclads’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Strand Magazine’ পত্রিকায় ডিসেম্বর ১৯০৩ সালে। এই গল্পেই প্রথম সাঁজোয়া গাড়ির আবির্ভাব হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্যাঙ্ক ব্যাবহারের প্রায় ১৩ বছর আগে।]
০১.
রণ-সাংবাদিকের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে, চোখে দূরবিন লাগিয়ে শক্রব্যুহের অলস প্রশান্তি দেখে খুশিতে ফেটে পড়ল তরুণ লেফটেন্যান্ট।
এক মাস হতে চলল–একই দৃশ্য দেখে দেখে চোখ পচে গেছে দুজনেরই। যুদ্ধ ঘোষণার পর বেশ ভালোই লেগেছিল সাংবাদিকমশায়ের। চুটিয়ে প্রতিবেদন লেখা যাবে রণক্ষেত্র থেকে দারুণ লড়াইয়ের রক্ত গরম-করা রিপোর্ট।
কিন্তু কোথায় লড়াই? বীরবিক্রমে রাজধানী দখল করতে যাওয়ার সময়ে যা একটু বাধা দিয়েছিল শত্রুপক্ষ, ঘোড়সওয়ার আর সাইকেলবাহিনী খুব খানিকটা লম্ফঝম্প করেছিল হানাদারবাহিনীর সামনে। কিন্তু পেছিয়ে গিয়েছিল–তেমন একটা লড়াইয়ের মধ্যে যায়নি বলেই হতাহতও খুব বেশি হয়নি।
তারপরেই সারি সারি ট্রেঞ্চের মধ্যে সেই থেকে বসে আছে তো বসেই আছে। রাজধানী রক্ষে করছে এইভাবে!
দূর! দূর! এর নাম লড়াই? কোথায় দুমদাম করে রাইফেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসবে, কামান গর্জনে প্রান্তর কাঁপিয়ে ছাড়বে, বেয়নেট ঝলসে উঠবে, ঘোড়ার পায়ে ধুলো উড়বে, বারুদের ধোঁয়ায় আকাশ ঢেকে যাবে–তবেই না লড়াই।
কিন্তু তা তো নয়! সারি সারি ট্রেঞ্চ কেটে ভেতরে ঢুকে বসে আছে ইঁদুরের মতো। রাতের পর রাত কেটে যাচ্ছে, প্রত্যেকেই ভাবছে, ভোর হলেই বুঝি তেড়ে আসবে বিউগল বাজিয়ে–কিন্তু তার কোনও লক্ষণই নেই।
আজ রাতের মতোই প্রতিরাতে দেখা গেছে কেবল সঞ্চরমাণ লণ্ঠন, ছোট ছোট অগ্নিকুণ্ড, আগুন ঘিরে বসে আড্ডায় মশগুল কিছু লোক। কাঠখোট্টা উঁদে সৈন্যদের মতো তাদের চেহারাও নয়।
লেফটেন্যান্টও তা-ই বলেছিল সাংবাদিককে। লড়বার ক্ষমতা থাকলে তো লড়বে? যুদ্ধবাজ তো কেউই নয়। কেউ কলম-পেষা কেরানি, কেউ লেখক, কেউ কারখানার শ্রমিক, কেউ শান্তিপ্রিয় সভ্য নাগরিক। রোদে পোড়া চামড়া, কটমটে চাউনি, তাগড়াই গোঁফ–কারওই নেই। খাঁটি সৈন্যের এইসবই তো লক্ষণ–যেমন রয়েছে তাদের সৈন্যদের মধ্যে। দেখলেও বুক দুরদুর করে ওঠে।
তাহলে আর কেন ওদের আক্রমণের অপেক্ষায় বসে থাকবেন? ঝাঁপিয়ে পড়লেই তো হয়? জানতে চেয়েছিল রণ-সাংবাদিক।
মুশকিল তো সেইখানেই, মুচকি হেসে বলেছিল তরুণ লেফটেন্যান্ট–রক্ত তেতে না উঠলে একদল কেরানি, কুলি আর শহুরের ওপর কি খামকা ঝাঁপিয়ে পড়া যায়?
তা-ই বলে কি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এমনিভাবে বসে থাকতে হবে? প্রতিরাতেই আশ্বাস দিয়ে চলেছে তরুণ লেফটেন্যান্ট–ভোর হোক, নিশ্চয় তেড়ে আসবে– এরাও মারমার করে তেড়ে গিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে।
হঠাৎ চমকে ওঠে তরুণ লেফটেন্যাটও কী?
চমকে ওঠে সাংবাদিকও–কী হল?
গাছের সারির মাথায় কালোমতো কী যেন দেখলাম?
কই দেখি? দূরবিনটা টেনে নিয়ে অজানা বস্তুটাকে অন্বেষণ করে সাংবাদিক।
কিন্তু বৃথাই। নিকষ আঁধারের মধ্যে সঞ্চরমাণ লণ্ঠন আর শান্তিপ্রিয় যুদ্ধ-অরুচি কিছু লোক ছাড়া কাউকে দেখা যায় না।