.
৩। প্রথম ঘোড়সওয়ার
বুদ্ধিই শক্তি। মানুষ আজ বুদ্ধির জোরেই মুঠোয় এনেছে পৃথিবীটাকে। কিন্তু তা একদিনে ঘটেনি। জঙ্গলের পশুনিধনই শুধু নয়, পশুকে বশও করতে হয়েছে এই বুদ্ধির জোরে।
ঘোড়া আজকে অতীব প্রিয় বাহন। কলের বাহনের অভাব নেই–ঘোড়ার কদর কিন্তু আজও যায়নি।
আঘ-লোমিই প্রথম মানুষ, যে ঘোড়া দেখে মুগ্ধ হয়েছিল, ঘোড়ার কদর করতে শিখেছিল, ঘোড়ার পিঠে চেপেছিল।
ওদের আস্তানার কিছু দূরেই খোলা ঘাসজমিতে চরতে আসত একপাল বুনো ঘোড়া। দূর থেকে অবাক হয়ে দেখত আঘ-লোমি। শিং নেই, খোঁচা দাঁত নেই কিন্তু কী আশ্চর্য ছোটার বেগ। লাথির জোর অবশ্য আছে–কিন্তু ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়ানোর কায়দাটা অপূর্ব।
রোজ এইভাবে দেখতে দেখতে একটা মতলব মাথায় এল আঘ-লোমির।
নিরস্ত্র অবস্থায় বসে রইল মাঠের মাঝখানে। ঘোড়ার পাল দূর থেকে দেখল, বাঁদরের মতো একটা জীব চুপচাপ বসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে। কাজেই অযথা মাথা না ঘামিয়ে ব্যস্ত রইল ঘাস খাওয়া নিয়ে।
প্রথম দিন গেল এইভাবে। দ্বিতীয় দিন আরও কাছে সরে বসল আঘ-লোমি।
তৃতীয় দিন আরও কাছে। আস্তে আস্তে ওর সান্নিধ্য গা-সওয়া হয়ে গেল ঘোড়াদের।
সবচেয়ে তেজিয়ান ঘোড়াটাকে আগে থেকেই দেখে রেখেছিল আঘ-লোমি। তক্কে তকে ছিল তার পিঠে চাপবার। তরুণ বয়স তো, অ্যাডভেঞ্চারের মোহ রক্তে।
একদিন সুযোগটা এসে গেল হাতে।
ঘোড়ার পাল যে পথ দিয়ে রোজ ফিরে যায় ধুলো উড়িয়ে, সেই পথে একটা গাছের ডালে বসে রইল আঘ-লোমি৷ তেজিয়ান ঘোড়াটা পায়ের তলায় আসতেই টুপ করে লাফিয়ে নেমে এল পিঠে৷
আচমকা পিঠের ওপর কী খসে পড়ায় বিষম আতঙ্কে টেনে দৌড়েছিল ঘোড়াটা। খটখটাখট শব্দে প্রান্তির কাঁপিয়ে, চার পায়ে ধুলো উড়িয়ে ছুটেছিল দিশেহারা হয়ে। কেশর খামচে ধরে, দুপা দিয়ে ঘোড়ার দুপাশ আঁকড়ে ধরে কোনওমতে পিঠে বসে ছিল আঘ লোমি। মাঠ-বন-নদী পেরিয়ে ঘোড়া বেচারা ছুটেছিল ঊধ্বশ্বাসে। ফেনা গড়িয়ে পড়েছিল কষ বেয়ে। বেদম হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শির-পা হয়ে খসিয়ে ফেলতে চেয়েছিল পিঠের উৎপাতকে, দুপা মুড়ে বসে পড়েও পিঠ থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিল আপদটাকে। কিন্তু পারেনি–কিছুতেই পারেনি। নাছোড়বান্দা আঘ-লোমিকে কিছুতেই পিঠ থেকে খসিয়ে ফেলা যায়নি। আবার শুরু হয়েছিল খটখটাখট খটখটাখট শব্দে মাঠ-বন-প্রান্তর কাঁপিয়ে দৌড়।
দৌড়াতে দৌড়াতে এসে পৌঁছেছিল একটা নদীর ধারে। ঝাঁকুনির চোটে আঘ-লোমির অবস্থাও তখন কাহিল। ঝুলছে একপাশে। কিন্তু কেশর ছাড়েনি মুঠো থেকে। এইখানেই আচমকা বাহন দাঁড়িয়ে যেতেই পিঠ থেকে ঠিকরে গিয়েছিল আঘ-লোমি। তৎক্ষণাৎ হ্রেষা রবে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে বনের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছিল মানুষের হাতে পরাভূত প্রথম ঘোড়াটি।
বিশ্বের প্রথম ঘোড়সওয়ারটি কিন্তু এল কোথায়? এ যে তারই পুরানো আস্তানা। নদীর ওপারে ওই তো মেয়েরা অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। চার পেয়ের পিঠ থেকে দুপেয়েকে অবতীর্ণ হতে দেখে হতভম্ব প্রত্যেকেই।
এরপরেই নতুন অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয়ে গেল আঘ-লোমির টগবগে তাজা জীবনে।
.
৪। সিংহের নাম উয়ায়া
জোর যার মুলুক তার–এই তো নীতি এখনকার দুনিয়ার?
কিন্তু এ নীতি খুবই আদিম নীতি। এ গল্পের নায়ক আদিম মানুষ আঘ-লোমি গায়ের জোরে আর বুদ্ধির জোরে মুলুক দখল করেই তার প্রমাণ রেখে গিয়েছিল ইতিহাসেরও আগের ইতিহাসে।
ঘোড়ার পিঠ থেকে ঠিকরে পড়েই চম্পট দিয়েছিল সে। নদীর ওপার থেকে মেয়েরা তাকে ডেকেছিল–তবুও যায়নি। শুধু দেখেছিল, দলে পুরুষ একজনও না। শিকারে গেছে নিশ্চয়।
শিকারে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পশু শিকারে নয়, মানুষে শিকারের অভিযানে। এবং, আঘ-লোমি আর ইউদেনাই সেই মানুষ।
তাই, নিজের ডেরায় ফিরে এসে ইউনোকে আর দেখতে পায়নি আঘ-লোমি।
ব্যাপারটা আঁচ করতে দেরি হয়নি। তৎক্ষণাৎ কুঠার ঘাড়ে রওনা হয়েছিল ইউদেনা উদ্ধারের অভিযানে।
ইতিমধ্যে ইউদেনাকে নিয়ে ফিরে এল তারই উপজাতির মানুষরা। বিস্তর নিগ্রহ করার পর দিনকয়েক পরে বেঁধে রেখে এল জঙ্গলের মধ্যে সিংহ দিয়ে খাওয়ানোর জন্যে।
বেশ কিছুদিন ধরেই বুড়ো সিংহটা উৎপাত জুড়েছিল এদের ডেরায়। রোজই একজনকে ধরে নিয়ে যেত আগুনের কুণ্ড টপকে এসে। গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল, ধড়িবাজ উয়ায়া মরে সিংহ হয়েছে। হত্যাকারী আঘ-লোমি আর তার দোসর ইউদোকে না-খাওয়া পর্যন্ত কারও নিস্তার নেই।
সুতরাং উয়ায়া নামক সিংহটিকে ঠান্ডা করার জন্যেই ইউদোকে বেঁধে রেখে আসা হল গভীর জঙ্গলে।
রাত হল। কাঠ হয়ে রয়েছে ইউনো। আশপাশে শোনা যাচ্ছে নিশাচরদের হাঁকডাক। একবার রক্ত জল-করা গজরানিও শোনা গেল। সিংহের গর্জন। সত্যিই যেন রক্ত জল হয়ে এল ইউদেনার।
তারপরেই খসখস করে নড়ে উঠল ঝোপঝাড়। টলতে টলতে বেরিয়ে এল—
সিংহ নয়–আঘ-লোমি।
প্রস্তর-কুঠারের মহিমা প্রাণ দিয়ে বুঝেছে সিংহ। কিন্তু মারাত্মক জখম করে ছেড়েছে আঘ-লোমিকেও। একটা পা ফালাফালা করে দিয়েছে থাবার ঘায়ে।
জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গেল ইউদেনা নিঝুম আঘ-লোমিকে নিয়ে।
.
৫। শেষ লড়াই
দুজনে লুকিয়ে রইল একটা অলডার গাছের তলায়। ওঠবার ক্ষমতা নেই আঘ-লোমির। গুঁড়িতে পিঠ দিয়ে বসে রইল দিনের পর দিন। সে যুগের মানুষ বলেই ওষুধপত্তরের দরকার হল না। ক্ষতস্থান সেরে আসতে লাগল একটু একটু করে।