পলাতকরা ততক্ষণে নদীর ধারে পৌঁছে গেছে। আঘ-লোমি নদী পেরিয়ে ওপরে উঠে দৌড়াচ্ছে। নদীর মাঝামাঝি যখন পৌঁছেছে ইউদেনা, এমন সময়ে….
নদীর এপারে এসে পৌঁছাল বাউ। বিকট উল্লাসে ফেটে পড়ল নাগালের মধ্যে ইউনোকে পেয়ে। আদিম মানুষদের কাছে নরমাংস বড় প্রিয়। আজকের ভূরিভোজ হবে যে ওই দুজনের অন্তত একজনকে দিয়ে।
অতএব দুহাতে ধরা চকমকি পাথর দুটোর একটা উঁচিয়ে ধরল মাথার ওপর। ঝিনুকের গড়নে ক্ষুরের মতো ধারালো পাথর।
পাথর নিক্ষিপ্ত হল ইউদেনার দিকে। বাউয়ের লক্ষ্য কখনও ফসকায় না। ইউদোর হাঁটু কেটে রক্তারক্তি করে দিয়ে ঠিকরে গেল পাথর। যন্ত্রণায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে পাড় বেয়ে উঠতে যাচ্ছে ইউদেনা, এমন সময়ে ঠিকরে এল দ্বিতীয় ধারালো পাথরটা।
কিন্তু বেরিয়ে গেল মাথার পাশ দিয়ে। কেননা, ইউদোর গোঙানি শুনে ফিরে এসেছিল। আঘ-লোমি। এক ঝটকায় ইউদোকে টেনে এনেছিল পাথরের গতিপথ থেকে।
বাউ লাফিয়ে পড়েছে জলে। দেখল আঘ-লোমি। ইউদোকে টেনে টেনে ওপরে নিয়ে গিয়েই ছুটল লম্বা লম্বা লাফ মেরে। কিন্তু ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে অত জোরে দৌড়ানোর ক্ষমতা তো আর নেই ইউদোর। পিছিয়ে পড়ল বেচারি।
এদিকে বাউ উঠে এল বলে পাড়ে।
দেখেই আবার ফিরে এল আঘ-লোমি। হিংস্র বিকট চিৎকার ছেড়ে হরিণের শিং ঘোরাতে ঘোরাতে ধেয়ে গেল বাউয়ের দিকে। এক ঘায়েই ঠিকরে গেল বাউ। জল লাল হয়ে গেল তার রক্তে।
হাঁপাতে হাঁপাতে ওপারে তখন এসে পৌঁছেছে উয়ায়া। দুজন ডাকাবুকো ছোকরা নদীর মাঝবরাবর গিয়েই আঘ-লোমির খুনে চেহারা দেখে পেছন ফিরেই চম্পট দিচ্ছে উয়ায়ার দিকে।
ওই পর্যন্ত দেখেই আর দাঁড়ায়নি আঘ-লোমি। পালিয়েছিল ইউজেনাকে নিয়ে। শক্তের ভক্ত প্রত্যেকেই। তরুণ আঘ-লোমি দেখিয়ে দিয়েছে শক্তির নমুনা। হঠাৎ যেন পূর্ণ মানুষ হয়ে গিয়েছে। উয়ায়া পর্যন্ত অবাক হয়েছে, ভয় পেয়েছে তার হুংকার শুনে, তার শিং ঘোরানো দেখে, এক ঘায়ে বাউ-নিধন দেখে।
অতএব, কেউ আর তার পেছন নিল না। ছুটতে ছুটতে অনেক দূর এসে বার্চ গাছে উঠে রাত কাটাল দুজনে। ঘুম এল না চোখে। খিদেও পেয়েছে বিলক্ষণ। শাখাপ্রশাখা আর কচি পাতা চিবিয়ে নিয়ে পেটের জ্বালা কমানো গেল কোনওমতে। গভীর রাতে অনেক হিংস্র পশু টহল দিয়ে গেল গাছতলায়। হেলেদুলে চলে গেল একটা লোমশ গন্ডার।
ভোর হতেই আরও দূরে সরে এল দুজনে। পৌঁছাল একটা নদীর পাড়ে। বিস্তর চকমকি পাথর পড়ে ছিল সেখানে। পাথর ঠুকে জ্বালিয়ে নিল দুজনে। পাথর ছুঁড়ে একটা খরগোশ মেরে আনল আঘ-লোমি৷ আগুনে পুড়িয়ে খেল মাংস। তারপর বসল চকমকি পাথরে শান দিতে।
হঠাৎ হাতে উঠে এল একটা অদ্ভুত পাথর। মাঝখানে একটা ফুটো। এরকম পাথর কখনও দেখেনি আঘ-লোমি। উলটে-পালটে দেখে কাঠের ডান্ডাটা গলিয়ে দিল ভেতরে খেলার ছলে। ডান্ডার ডগায় এত জোরে এঁটে গেল পাথরটা, যে টেনে খুলে আনতেও পারল না। মাথার ওপর বাঁইবাঁই করে ঘুরিয়ে দেখলে, বেশ ভারীও বটে। অস্ত্র হিসেবে মন্দ নয়।
কুঠার আবিষ্কার করল মানুষ এইভাবে।
তারপর? দিনকয়েক পরে পুরানো আস্তানায় ফিরে গেল আঘ-লোমি–একা। দুদিন দুরাত আগুন জ্বালিয়ে একা বসে রইল। আঘ-লোমি ফিরে এসে উপহার দিলে একটা কণ্ঠহার।
চমকে উঠেছিল ইউদেনা। এ যে উয়ায়ার কণ্ঠহার!
কুঠার তুলে দেখিয়েছিল আঘ-লোমি। রক্তরঞ্জিত কুঠার। উয়ায়ার রক্ত। নতুন অস্ত্র কুঠারের এক ঘায়েই খতম হয়ে গিয়েছে ধড়িবাজ উয়ায়া। অঙ্গভঙ্গি করে বাঁইবাঁই করে মাথার ওপর কুঠার ঘুরিয়ে আঘ-লোমি দেখিয়ে দিলে, পরম শত্রুকে হনন করেছে সে কীভাবে।
পঞ্চাশ হাজার বছর আগে এইভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষ শিখল প্রস্তর কুঠারের মহিমা।
.
২। গুহা ভালুক
নতুন অস্ত্র দিয়ে জঙ্গলের রাজাকে জখম করল আঘ-লোমি এর কদিন পরেই।
দুজনে ঠাঁই নিয়েছিল একটা সংকীর্ণ খাদের মধ্যে। জন্তুজানোয়ারের উপদ্রব এখানে নেই। রাত্রে চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দিব্যি ঘুমানো যায়।
কিন্তু এহেন নিরাপদ জায়গাতেও একরাত্রে হানা দিল অরণ্যের আতঙ্ক আন্দু-মানে, গুহা-ভালুক।
আন্দু কদিন ধরেই দেখছিল, দুটো দুপেয়ে জানোয়ার ঘুরঘুর করছে তার এলাকায়। দেখতে বাঁদরের মতো, আবার শুয়োরের মতোও বটে। শুয়োরের গায়েই অত লোম থাকে। গিন্নিকেও বলেছিল এই নতুন উৎপাতের কথা। মানুষ তখনও এ অঞ্চলে বেশি আসেনি। আন্দু তাই অবাক হয়েছিল প্রথম মানুষ দেখে।
চুপিসারে একদিন হানা দিয়েছিল খাদের মধ্যে। গাছপালা আঁকড়ে ধরে একটু একটু করে খাড়া দেওয়াল বেয়ে নেমে এসেছিল নিচে। কিন্তু শূন্যে ঝুলন্ত অবস্থাতেই কোপ খেল প্রস্তর-কুঠারের।
মারাত্মক কোপ! জখম হয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে, দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল রাজা আন্দু৷ সেই ফাঁকে চম্পট দিলে মানুষ-শুয়োর দুটো।
মুখ চুন করে রক্তাক্ত দেহে গুহায় ফিরে এসেছিল আন্দু। গিন্নি তো অবাক রাজামশায়ের হাল দেখে।
এরপরেই যা ঘটল, তা কহতব্য নয়।
ভালুক-গুহায় পাথর খসে পড়ল ওপর থেকে। পড়ল এক্কেবারে আন্দুর মাথার ওপর। করোটি চুরমার হল সঙ্গে সঙ্গে। আন্দু আর নড়ল না।
বিকট হল্লা শুনে কোনওরকমে ওপরে তাকিয়ে আন্দুর বউ দেখেছিল সেই বাঁদর-শুয়োর দুটোকে। নাচছে আর চেঁচাচ্ছে।
প্রস্তর-কুঠার আর বুদ্ধির জোরে এইভাবেই জঙ্গলেও আধিপত্য বিস্তার শুরু করল আদিম মানব… আজ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।