ভোর হল। সূর্য উঠল। ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল ইউদেনা। নেমে এল গাছ থেকে। কিন্তু যাবে কোনদিকে? একরাত বনে কাটিয়েই পথ গুলিয়ে গেছে। কান খাড়া করে রইল কিছুক্ষণ। অনেক দূর থেকে ভেসে এল একটা ক্ষীণ ঠং ঠং শদ। চকমকি শান দেওয়ার শব্দ।
শব্দ লক্ষ্য করে এগল ইউনো। অচিরেই দেখল একটা চেনা গাছ, ওপরে মৌমাছি উড়ছে ভনভন করে। তারপরেই কানে ভেসে এল নদীর জলে জলহস্তী আর বাচ্চাদের দাপাদাপির শব্দ। ওই তো দেখা যাচ্ছে নদী। ওই তো সেই অলডারকুঞ্জ, যার মধ্যে লুকিয়েছিল ইউনো। দেখেই উয়ায়া-আতঙ্ক আবার পেয়ে বসল বেচারাকে। লুকিয়ে রইল জঙ্গলে।
খিদে পেলেও কাতর হয়নি। আধুনিকাদের মতো তিন ঘণ্টা অন্তর খাওয়ার ট্রেনিং তো পায়নি। দরকার হলে তিন দিন না খেয়েও থাকতে পারে, কাহিল হয় না। সারারাত বনে কাটিয়ে গা-হাত-পা একটু আড়ষ্ট হয়েছে বটে, তবে সহবত দেখাতে গিয়ে আধুনিকাদের আড়ষ্ট হওয়ার মতো নয়। ভয়? পাবে বইকী। ডাগর চেহারা হলেও মনে মনে ইউদেনা তো বালিকা। তবে আধুনিকাদের মতো ছায়া দেখে চিল-চেঁচানোর মতো ভয়কাতুরে নয়। আমাদের ইউদেনা।
বাউ ছাড়া কোনও পুরুষকে দেখা যাচ্ছে না। চকমকি ঠুকে শান দেওয়াই ওর কাজ। বাউকে দেখে নিশ্চিন্ত হল ইউদেনা। অন্য পুরুষরা নিশ্চয় শিকারে বেরিয়েছে। কয়েকজন মেয়েও গেছে নদীর ধারে। হেঁট হয়ে শামুক-গেঁড়ি কুড়াচ্ছে। দেখেই খিদে পেয়ে গেল ইউদেনার। দৌড়ে গেল ফার্ন গাছের আশপাশ দিয়ে। মতলব, মেয়েদের সঙ্গে ভিড়ে যাওয়া। আচমকা শুনল, মৃদুস্বরে কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে। থমকে দাঁড়াতেই পেছন থেকে খড়মড় শব্দে ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে এল আঘ-লোমি। দুচোখে যেন আগুন জলছে। মুখে রক্ত। শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে। হাতে উয়ায়ার সেই সাদা পাথর। সাদা আগুন-পাথর। এ পাথর উয়ায়া ছাড়া কেউ ছোঁয় না, কিন্তু বুকের পাটা তো কম নয় আঘ-লোমির! উয়ায়ার সাদা পাথর ওর হাতে এল কী করে?
লাফিয়ে পাশে এসে দাঁড়াল আঘ-লোমি। খপ করে খামচে ধরল ইউদোর বাহু, ঠেলে নিয়ে গেল ঝোপের মধ্যে।
যেতে যেতেই ইউদেনা শুনল, শোরগোল উঠেছে পেছনে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, জল ঠেলে এগিয়ে আসছে দুটি মেয়ে। উঠে দাঁড়িয়েছে অন্য মেয়েরা। আগুনে কাঠ গুঁজে আগুন জ্বালিয়ে রাখা যার কাজ, দাড়িওয়ালা সেই বুড়িটা দুহাত নেড়ে চেঁচাচ্ছে। চকমকি ঠোকা বন্ধ রেখে উঠে দাঁড়িয়েছে বাউ। চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটছে বাচ্চার দল।
ব্যাপারটা কী? স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ইউদেনা।
তাড়া লাগাল আঘ-লোমি। বুঝিয়ে দিল কী ব্যাপার। উয়ায়া মৃত্যু পরোয়ানা ছেড়েছে দুজনের নামে। রক্ষে নেই ইউদেনা আর আঘ-লোমির।
আর বোঝানোর দরকার হল না। শুধু মেয়েরা নয়, আস্তানার দিক থেকেও দুজন বেটাছেলে আসছে এদিকে। জঙ্গলের মধ্যে থেকেও বেরিয়ে আসতে দেখা গেল একজনকে।
ইউদেনার হাত ধরে টেনে দৌড়াল আঘ-লোমি। দেখতে দেখতে আবার পৌঁছে গেল চেস্টনাট জঙ্গলে। এখন আর ভয় নেই ইউদেনার-আঘ-লোমি রয়েছে তো সঙ্গে। দৌড়ে বেশ মজাও পাচ্ছে। হাসছে খিলখিল করে। আঘ-লোমি দৌড়ায় ভালোই–তবে ইউদোর। সঙ্গে পাল্লা দিতে সে পারছে না।
খোলা জমি পেরিয়ে ফের চেস্টনাট জঙ্গলে গতিবেগ কমিয়ে আনল দুজনে। আর ভয় নেই। এত দূরে কেউ আসতে সাহস পাবে না।
ভুল ভেঙে গেল অচিরেই। হাত তুলে দেখাল ইউদেনা। গাছের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো মানুষের ছুটন্ত পা। উয়ায়ার ক্রুদ্ধ হুংকার শোনা গেল তারপরেই।
এবার ভয় পেল দুই পলাতক। দুদিক থেকে তেড়ে আসছে দুটো দল। একটা দলে রয়েছে উয়ায়া। আরেকটা দলে বাউ আর মেয়েরা। বাচ্চাগুলোসুদ্ধ ভিড়ে গেছে দল দুটোয়।
এবার ইউদেনা দৌড়াল আগে–আঘ-লোমি পেছনে। ঝোপঝাড় টপকে, খানাখন্দ পেরিয়ে, পশুচলা পথ মাড়িয়ে, কাদা পেরিয়ে, জলা পেরিয়ে দে দৌড়, দে দৌড়!
পেছন ফিরে দেখল ইউদেনা, পেছিয়ে পড়েছে আঘ-লোমি। খুবই স্বাভাবিক, উয়ায়ার আগুন-পাথর বয়ে আনতে হচ্ছে যে তাকে।
স্বয়ং উয়ায়াকে দেখা যাচ্ছে তার পেছনে। দলের আর সব পেছিয়ে পড়লেও শক্তিমান উয়ায় এগিয়ে আছে সবার আগে মাথার ওপর তুলে ধরেছে হরিণের ডালপালাওয়ালা শিং… যার প্রতিটি শাখার ডগা শানিয়ে ছুঁচোলো করা।
দুজনের মধ্যে ব্যবধান মোটে পঞ্চাশ গজ!
তাই পাশ ফিরে দৌড়াতে দৌড়াতে পেছনে নজর রাখল ইউনো। দেখল, ব্যবধান আরও কমে আসতেই হরিণের শিং ছুঁড়তে উদ্যত হয়েছে উয়ায়া।
সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল ইউদেনা, আঘ-লোমি, সাবধান!
শুনেই টুপ করে বসে পড়েছিল আঘ-লোমি। শনশন করে হরিণের শিং বেরিয়ে গিয়েছিল মাথার ওপর দিয়ে–কিন্তু একটা শাখার খোঁচা লেগে কেটে গেল মাথার চামড়া।
সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ হংকার ছেড়ে পেছন ফিরেই দুহাতের আগুন-পাথর ছুঁড়ে মারল আঘ লোমি উয়ায়ার দিকে। পাথর গিয়ে লাগল উয়ায়ার পাঁজরে। দম আটকে এল তৎক্ষণাৎ। হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে।
হরিণের শিংখানা কুড়িয়ে নিয়েই আঘ-লোমি দৌড়াল ইউদেনার দিকে। এবার আর ধরে কে! দৌড়! দৌড়! দৌড়!
এদিকে মাটিতে আছড়ে পড়েও টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে ফের দৌড়াতে গিয়ে উয়ায়া দেখলে, দম ফুরিয়ে যাচ্ছে–হাঁপ ধরছে। বাউ ছুটে এসেছে পেছন থেকে। উয়ায়ার পাশ দিয়ে দুদ্দাড় করে সে দৌড়ে গেল দুই পলাতকের দিকে।