একটু দূরেই নদীর জলে দাপাদাপি করছে একদল ছেলেমেয়ে। এদের বসতি নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে–সেইখানে। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে এখান থেকেও। কানে লতি নেই– ওপরের অংশ ছুঁচোলো-আজও এই ধরনের কান দেখা যায় কোনও কোনও জায়গায়। নাক থ্যাবড়া। পরনে কিসসু নেই। লম্বা বাহু। যাযাবরে ভবঘুরেদের ছেলেমেয়ে। মাথার চুল জট পাকানো–কপাল ঢেকে গেছে চুলের জটায়–ফ্যাশনটা দেখা যায় আজও।
জল ঘুনিয়ে খেলা করছে এরাও। জলহস্তীদের এগিয়ে আসতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল সোল্লাসে–বোলু! বোলু! বোলু! বায়ায়া, বোলু!
ফুর্তিবাজ ঠিকই কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করার ভাষাটা অপর্যাপ্ত।
বাচ্চাদের এই খেলার জায়গায় ছড়িয়ে আছে বিস্তর চকমকি পাথর। বাবা-মায়েরা দুহাত ভরে তুলে নিয়ে গিয়ে জড়ো করেছে নদীর বাঁকে। সকালবেলা শিকারি কুকুরের কামড়ে জখম হওয়া একটা হরিণের মাংস খেয়ে ভরপেট ঘুমাচ্ছে পুরুষরা হাঁটুতে মাথা রেখে। মেয়েরা এখনও হাড় চিবুচ্ছে আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলছে চারপাশে। বুড়িরা কাঠ খুঁজে দিচ্ছে ভায়া আগুন-এর মধ্যে যাতে–রাত ঘনিয়ে এলেই লম্বা হয়ে বনের পশুকে ঠেকিয়ে রাখে–নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়।
এদের কারও গায়ে পোশাক বলে কিছু নেই। কয়েকজনের কোমর ঘিরে ঝুলছে পশুর চামড়া। আর ঝুলছে একটা করে থলি। থলি ভরতি চকমকি পাথর–সেই যুগের মূল হাতিয়ার। কোনওমতে মেজে-ঘষে ধারালো করা পাথর। এদের সর্দারের নাম ধড়িবাজ উয়ায়া। গালে কালো দাড়ি। বুকে কালো লোম। বাহুবল এবং বুদ্ধিবলে সে এদের দলপতি। চকমকি পাথর দিয়ে ছুঁচোলো করছে একটা হাড়। সবাই ঘুমাচ্ছে–জেগে বসে আছে কেবল উয়ায়া। তার বউয়ের গলা ঘিরে দুলছে ঘেঁদা-করা জীবাশ্মর মালা। বসে বসে যারা ঘুমাচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের পাশে রয়েছে শান দিয়ে ছুঁচোলো করা হরিণের শিং আর চকমকির ফলা লাগানো কাঠের ডান্ডা।
জঙ্গলের অলডার গাছের আড়ালে লুকিয়ে একটি মেয়ে চেয়ে রয়েছে এইদিকে। এর নাম ইউদেনা। নেহাতই বালিকা। চকচকে চোখ। হাসিটি সুন্দর। আজ তাকে উয়ায়া বড় রকমের মাংসের টুকরো খেতে দিতেই নেকলেস গলায় বউটা গজরে উঠছিল গলার মধ্যে। ঈর্ষা। সঙ্গে সঙ্গে চাপা গজরানি ছেড়েছিল একটি তরুণ। নাম তার আঘ-লোমি। ইউদেনা একদৃষ্টে আঘ-লোমির দিকে চেয়ে ছিল কিছুক্ষণ। চোখ নামিয়ে নিয়েছিল আঘ-লোমি। কিন্তু ইউদোর দিকে চোখ তুলেছিল উয়ায়া। চোখের চাহনিটা ভালো লাগেনি ইউদেনার। ভয়ে পালিয়ে এসেছে জঙ্গলে। উয়ায়া হাড় ছুঁচোলো করছে কেন, বোঝা যাচ্ছে না। আঘ লোমিকেও ধারেকাছে দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ কোত্থেকে একটা কাঠবেড়ালি এসে ধমকাধমকি শুরু করে দিলে ইউদেনাকে। ভাবখানা যেন, সাহস তো তোমার কম নয়? বেটাছেলেদের কাছ থেকে এত দূরে এসেছ জঙ্গলে? যাও, ভাগ হিয়াসে!
কাঠের টুকরো ছুঁড়ে মেরেছিল ইউদেন। পাশ কাটিয়ে দূরে সরে গিয়েও তড়পানি কমেনি কাঠবেড়ালির। কাঠ ছুঁড়তে ছুঁড়তে এবার তাড়া করল ইউদো। খেলা মন্দ নয়। কিন্তু…
চোখ তুলে তাকিয়েছে উয়ায়া। অলডার গাছ খুব নিচু গাছ। গাছের মাথায় হাত দেখা গেছে ইউদোর। উঠে দাঁড়াল উয়ায়া। চকমকি হাতে এগল সেইদিকে।
পিঠটান দিল ইউদেনা। উয়ায়ার রকমসকম তার ভালো লাগেনি। ঢাল বেয়ে উঠে গেল গভীর জঙ্গলে। দূর হতে দূরে। এত দূরে কখনও না এলেও খেলার ছলে এর কাছাকাছি আগে সে এসেছে। তাই প্রাণে ভয় নেই।
সন্ধ্যা নামছে। হঠাৎ শূকরের ঘোঁতঘোঁতানি শোনা গেল অদূরে।
সরে দাঁড়াল ইউদেনা।
তারপরেই শুনল ধাবমান একটা শব্দ।
গাছের ডাল ধরে বানরের মতোই দোল খেয়ে ওপরে উঠে বসল ইউদেনা।
তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল দাঁতালো বরাহটা, ধাবমান শব্দটা কিন্তু এগিয়েই আসছে। একটা হরিণও ছুটে গেল তলা দিয়ে। ভয় পেয়েছে। বরাহ আর হরিণ–দুটোই ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। কীসের ভয়ে?
বিষম উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে শব্দের দিকে চেয়ে রইল ইউদো।
আচমকা জঙ্গলের মধ্যে থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল আঘ-লোমি। মুখে রক্তের দাগ। ফের উধাও হল জঙ্গলের মধ্যে।
ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে-আসা শব্দটা তো কই থামল না?
আবার দেখা গেল একটা ছুটন্ত মূর্তিকে। উয়ায়া। প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। মুখ সাদা। লম্বা লম্বা লাফ মেরে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের মধ্যে।
তারপরেই বেরিয়ে এল জঙ্গলের রাজা–গ্রিজলি ভালুক। রাজামশাইকে কোনওদিন দেখবার সৌভাগ্য হয়নি ইউদেনার। নাম শুনেছে ছেলেবেলা থেকেই। দুষ্টুমি করলেই মায়েরা যার নাম করে ভয় দেখায়, এই সেই অরণ্য অধিপতি মহাভয়ংকর গ্রিজলি ভালুক। বিরাটকায় লোমশ সচল টিলা বললেই চলে। অরণ্যের আতঙ্ক নামটা অকারণে দেওয়া হয়নি।
পলায়মান মানুষ দুটোকে উদ্দেশ্য করেই তর্জন-গর্জন করে চলেছে জঙ্গলের বিভীষিকা। এত বড় আস্পদ্দা–তারই এলাকায় রক্তারক্তি, মারামারি? আরে, আমি হলাম গিয়ে জঙ্গলের রাজা, গুহামানবদেরও রাজা… একটু সমঝে চল!
ঘোঁতঘোঁত গরগর করতে করতে হেলেদুলে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল অরণ্য আতঙ্ক।
গাছেই বসে রইল ইউদেনা। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল জঙ্গলের রাজা, উধাও হল ওপরের দিকে। কিন্তু উয়ায়া অথবা আঘ-লোমি তো কই এল না। রাত হল। নদীর ধারে জল খেতে নামল ম্যামথ হাতির দল। দূর থেকেই বৃংহতি ডাক শুনেই চিনতে পারল ইউদেনা। বাছুরের মতো ডাকতে ডাকতে গাছের তলা দিয়ে চলে গেল বৃহদাকার একটা প্রাণী। খুব সম্ভব ইয়ায়া গন্ডার। তারা দেখা দিল আকাশে। সারারাত ভয়ের চোটে ঘুমাতে পারল না বেচারি। সঞ্চরমাণ ছায়া দেখে আঁতকে উঠল বারবার।