মেঘ ঘনিয়ে এল তারপরেই। মুছে গেল আকাশের দৃশ্য। বজ্রপাত আর বিদ্যুতের ঝিকিমিকি নতুন পোশাক দিয়ে মুড়ে দিল গোটা পৃথিবীকে। এমন বৃষ্টিপাত শুরু হল, যা পৃথিবীর মানুষ কখনও দেখেনি। সেই সঙ্গে খেপা আগ্নেয়গিরিগুলোও অকস্মাৎ লাভা উদগিরণ বন্ধ করে শুরু করল কাদাবমি। জল সরে গেল ডোবা জায়গা থেকে, বেরিয়ে এল কাদাজমি, সেই সঙ্গে দেখা গেল রাশি রাশি মড়া–বাচ্চা, বুড়ো, যুবক-যুবতীর। ঠিক যেন ঝড়জলে ধোয়া সমুদ্রসৈকত। মানুষ আর পশুর মৃতদেহ আটকে রইল পৃথিবীজোড়া কর্দম ভূমিতে। দিনের পর দিন কুণ্ডলী পাকিয়ে বাষ্প উড়ে গেল শুকিয়ে-আসা জমি থেকে, বিশাল খাত জেগে উঠল শুকনো কাদার বুকে। নক্ষত্রের আবির্ভাব এবং নিদারুণ উত্তাপের এই হল পরিণাম। এরই মধ্যে হপ্তার পর হপ্তা, মাসের পর মাস পৃথিবীর ঝুঁটি ধরে বারবার নাড়া দিয়ে চলল বিরামবিহীন ভূমিকম্প।
কিন্তু নক্ষত্র বিদায় নিতেই সাহস ফিরে পেয়েছিল পৃথিবীর মানুষ। একে একে ফিরে এল কাদায় বসে যাওয়া গোলাঘরে, পাঁকে ভরে যাওয়া চাষের মাঠে, ধ্বংস হয়ে যাওয়া নগরে নগরে। ঝড়জলের প্রকোপ এড়িয়ে টিকে গিয়েছিল যে কটা জাহাজ, বিমূঢ় অবস্থায় জল মেপে মেপে নতুন দিচিহ্ন ধরে ফিরে এল পরিচিত বন্দরগুলোয়। বাতাস কিন্তু গরম হয়ে রইল আগের চেয়ে, সূর্যও বড় হয়ে গিয়েছে মনে হল আগের চেয়ে–চাঁদের আয়তন কমে এসে ঠেকেছে যেন আগের আয়তনের এক-তৃতীয়াংশে। দিনরাতের হিসেবও গেছে পালটে।
নতুন ভ্রাতৃত্ববোধের সূচনা দেখা দিল পৃথিবী জুড়ে। কালান্তক নক্ষত্র হাড়ে হাড়ে শিখিয়ে দিয়ে গেল, বিশ্বমৈত্রী একান্তই প্রয়োজন। এক ফুৎকারে অবসান ঘটতে চলেছিল মানুষ জাতটার–কী হবে অযথা রেষারেষি, দ্বন্দ্ব-কলহ নিয়ে? এসো সবাই, এক হও পৃথিবীর মানুষ। পালটে গেল আইন, বই, মেশিন আর মানুষের মনের চেহারা। পালটে গেল আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড, বাফিন উপসাগরের উপকূলের চেহারা। শ্যামল সবুজ ভূমি দেখে চোখকেও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি অভিযাত্রী নাবিকরা। পৃথিবী আগের চেয়ে গরম হয়ে ওঠায় মানুষ জাতটা ছড়িয়ে পড়ল আরও উত্তরে আর দক্ষিণে–মেরু অঞ্চলে। বিশ্বশান্তি-মৈত্রী-সৌহারুদ এবং বিস্তৃত পতিত ভূখণ্ডে বসবাস–মহাকাশের আগন্তুক এই উপহারই দিয়ে গেল পৃথিবীকে।
মঙ্গল গ্রহের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতো নয় ঠিকই–বিপুল পার্থক্য এই দুই জগতের পণ্ডিতদের মধ্যে কিন্তু সেখানেও আগ্রহ সঞ্চারিত হল পৃথিবীব্যাপী এই প্রলয় এবং তারপরেই অভাবনীয় পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। একজন তো লিখেই বসল এইভাবে–মহাশূন্যের এই ভয়ংকর মিসাইলের বস্তুপিণ্ড আর উত্তাপের তুলনায় পৃথিবীর ক্ষতি খুব কমই হয়েছে বলতে হবে। সৌরজগতের মধ্যে দিয়ে সূর্যের দিকে নিক্ষিপ্ত এই জ্যোতিষ্ক পৃথিবীর কান ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়ে রেহাই দিল সৌরপরিবারের তৃতীয় গ্রহকে। সমুদ্ররেখা তেমন কিছু পালটায়নি দেখা যাচ্ছে–শুধু যা সাদা বিরংটা (সম্ভবত জমাট জল) গুটিয়ে ছোট হয়ে গেছে দুই মেরুর চারপাশে। এই লেখা থেকেই বোঝা যায়, কয়েক মিলিয়ন মাইল দূর থেকে পৃথিবীব্যাপী বিপর্যয়কে কী চোখে দেখা হয়েছে এবং কী হলেও হতে পারত–কিন্তু হয়নি! ম্যামথ যখন ছিল এই পৃথিবীতে, এ গল্প তখনকার গল্প। কীভাবে মানুষ প্রভাব বিস্তার করল পশুজগতের ওপর–এ গল্প সেই গল্প।
প্রস্তরযুগের একটি গল্প
প্রস্তরযুগের একটি গল্প ( A Story of the Stone Age )
[‘A Story of the Stone Age’ প্রথম প্রকাশিত হয় ধারাবাহিক আকারে ‘The Idler’ পত্রিকায় ১৮৯৭ সালে। পরে ‘Doubleday & McClure Co.’ থেকে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ‘Tales of Space and Time’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। নভেম্বর ১৯২৭ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়।]
১। আঘ-লোমি আর উয়ায়া
এ গল্প ইতিহাস শুরু হওয়ার আগের গল্প। মানুষের স্মৃতি যদূর পৌঁছায়, তারও ওপারের গল্প। তখন মানুষ হেঁটেই চলে যেতে পারত আজকের ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে। তখন ঘোলাটে জলের চওড়া নদী টেমস আর তার জনক নদী রাইনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল জলাভূমির মধ্যে দিয়ে। মাঝখানে ছিল বিরাট সমতলভূমি–এখন যা উত্তর সাগর নামক জলরাশির তলায় তলিয়ে গেছে। ডাউন্সের সানুদেশ বরাবর উপত্যকার অস্তিত্ব ছিল না সুদূর সেই যুগে। সারের দক্ষিণে ছিল একটা পর্বতমালা। মাঝামাঝি ঢালু জায়গায় বিরাজ করত নিবিড় ফার বৃক্ষ। বছরের বেশির ভাগ সময় তুষার-ঢাকা থাকত শীর্ষদেশ। পর্বতমালার নিচের থাকে তৃণভূমিতে চরে বেড়াত বুনো ঘোড়া, জঙ্গলে টহল দিত হায়না আর বৃহদাকার ভয়ংকর ধূসর রঙের গ্রিজলি ভালুক। ডালে ডালে বিচরণ করত ধূসরবর্ণ বনমানুষ। তারও নিচে অরণ্য, জল আর ঘাসজমির মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ছোট্ট একটা নাটক। এ কাহিনি সেই নাটকেরই কাহিনি। পঞ্চাশ হাজার বছর আগেকার কাহিনি –ভূতত্ত্ববিদদের হিসাব অনুযায়ী।
এ যুগের মতো সে যুগেও বসন্ত ঋতুতে পলক জাগত প্রাণে, রক্ত উত্তাল হত ধমনিতে। বিকেলের আকাশ টলটলে নীল। পাল তুলে ভেসে যাচ্ছে সাদা মেঘের স্তূপ। দক্ষিণ-পশ্চিম সমীরণে গা জুড়িয়ে যাচ্ছে। উড়ে উড়ে খেলা করছে সোয়ালো পাখি। নদীর জল ঘুলিয়ে তুলছে কালো দৈত্যের মতো জলহস্তীর দল।