গনগনে অঙ্গারের মতো সাদা হয়ে গেল চীন দেশ, কিন্তু জাপান, জাভা আর পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলোর ওপর ম্যাড়মেড়ে লাল আগুনের বলের মতো দেখা গেল বৃহৎ তারকাকে উন্মত্ত আগ্নেয়গিরিগুলোর ছাই, বাষ্প আর ধোঁয়ার আবরণের মধ্যে দিয়ে। নতুন তারাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যেই এলাহি কাণ্ড আরম্ভ করে দিয়েছিল সব কটা আগ্নেয়গিরি একযোগে। মাথার ওপর লাভা, গরম গ্যাস আর ছাই–নিচে ফুঁসছে জল, মাটি কাঁপছে ভূমিকম্পে। দেখতে দেখতে গলে গেল হিমালয় আর তিব্বতের চিরতুষার। এক কোটি ধারায় ছেয়ে নেমে এল ব্রহ্মদেশ আর হিন্দুস্থানের ওপর। হাজারখানেক জায়গায় দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল ভারতের নিবিড় জঙ্গল। ধাবমান জলের মধ্যে দিয়েও দেখা গেল জায়গায় জায়গায় লেলিহান অগ্নিশিখা। রক্তের মতো লাল আগুন লক্ষ জিহ্বা মেলে নৃত্য করতে লাগল মহাপ্লাবনের মাঝে মাঝে। দিশেহারা মানুষ দৌড়াল নদীর তীর ছেড়ে একটাই দিকে–বাঁচবার শেষ ভরসা রয়েছে যেদিকে–সমুদ্রের দিকে।
এদিকে মুহুর্মুহু আকারে বেড়ে চলেছে প্রলয়-নক্ষত্র। আরও উত্তপ্ত, আরও উজ্জ্বল হচ্ছে। পলকে পলকে। সেই সঙ্গে এগিয়ে আসছে দ্রুত গতিবেগে। নিরক্ষীয় সমুদ্রে ধীর প্রশান্ত রোদ্দুর ঝিকমিক থাকে আবহমানকাল–কিন্তু নতুন তারা এগিয়ে আসার ফলে শান্ত জল হল অস্থির উত্তাল, বড় বড় কালো ঢেউ থেকে ফুঁসে উঠল তাল তাল বাষ্প, মাতাল ঝড়ের ঠেলায় পাক খেতে খেতে প্রেতাকারে সেই বাষ্পরাশি ধেয়ে গেল দিকে দিকে।
তারপরেই ঘটল একটা অদ্ভুত ব্যাপার। অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। ইউরোপে যারা নিষ্পলকে চেয়ে ছিল তারার উদয়ের প্রতীক্ষায়, হঠাৎ তাদের মনে হয়েছিল, পৃথিবীর বোঁ বোঁ আবর্তন বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেল অকস্মাৎ। হাজারে হাজারে যারা পালিয়েছিল ভেঙে পড়া বাড়ি, বন্যার প্রকোপ আর ধসের ধ্বংসলীলা এড়াতে, তারাও হতবাক হয়ে গেল কাণ্ড দেখে। নতুন তারা দিগন্ত ছাড়িয়ে দেখা দিচ্ছে না! কেন? কেটে গেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসহ্য উৎকণ্ঠা আর বিমূঢ়তার মধ্যে দিয়ে। তারার উদয় কিন্তু ঘটল না। চেনা নক্ষত্রমণ্ডলীগুলো দেখা গেছে পরিষ্কার আকাশে-মাটি যদিও কাঁপছে থরথর করে ঘন ঘন ভূমিকম্পে–কিন্তু গেল কোথায় মহাকাশের আগন্তুক?
নির্দিষ্ট সময়ের দশ ঘণ্টা পরে আবির্ভাব ঘটল তার–সেই সঙ্গে সূর্যর। কালান্তক তারকার সাদা গোল বুকের ঠিক মাঝখানে দেখা গেল একটা কালো চাকতি।
এশিয়ার মাথায় থাকার সময়ে আকাশের গতিপথ থেকে সরে যাচ্ছিল তারকা। ভারতের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল তীব্র আলো। সে রাতে সিন্ধু নদের মোহানা থেকে গঙ্গা নদীর মোহানা পর্যন্ত ভারতের বিস্তৃত সমতলভূমি ডুবে গিয়েছিল অগভীর জলে–চকচকে জলে ভূতুড়ে ছায়ার মতো নিজের প্রতিবিম্ব ফুটিয়ে তুলেছিল আকাশের আতঙ্ক। মন্দির আর প্রাসাদ, টিপি আর পাহাড় মাথা উঁচু করেছিল জল থেকে। কালো মানুষের ভিড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল মন্দির-মসজিদ-পাহাড়-টিলার শীর্ষদেশ। মিনার-গম্বুজ-স্মৃতিসৌধেও প্রাণ বাঁচাতে জড়ো হয়েছিল ভয়ার্ত মানুষ–কিন্তু প্রাণে বাঁচেনি কেউ–প্রচণ্ড উত্তাপ আর নিঃসীম আতঙ্কে মুহ্যমান অবস্থায় তলিয়ে গিয়েছিল চকচকে কালো জলে মিনার-গম্বুজ-স্মৃতিসৌধ একে একে ধসে পড়ার পর। হাহাকারে ভরে উঠেছিল ভারতের আকাশ-বাতাস। আচম্বিতে নারকীয় চুল্লির গনগনে দ্যুতির ওপর দিয়ে ভেসে গিয়েছিল যেন একটা হিমশীতল কালো ছায়া–সীমাহীন নৈরাশ্যব্যাপী পুরো তল্লাটটার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল হিমশীতল দমকা হাওয়া–পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ আবির্ভূত হয়েছিল মাথার ওপর। বাতাসে আগুনের হলকা কেন কমে এল, কেন হঠাৎ প্রখর দ্যুতি ঢেকে দিয়ে কালো ছায়া চকিতে ধেয়ে গেল দিগন্তব্যাপী জলরাশির ওপর দিয়ে–তা দেখার জন্যে বিভীষিকা-মুমূর্ষ মানুষগুলো ঘাড় বেঁকিয়ে চেয়েছিল আকাশপানে। চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু দেখা গিয়েছিল কালো চাকতিটাকে। রাক্ষুসে তারকার ওপর আস্তে আস্তে ভেসে আসছে একটা কালো চাকতি। পৃথিবী আর তারকার মধ্যে ঢুকছে চাঁদ–মারণ-উত্তাপ বুক পেতে নিয়ে শীতল করে তুলছে পৃথিবীকে। শুরু হয়েছে নক্ষত্র-গ্রহণ! মঙ্গলময় ঈশ্বরের লীলা প্রত্যক্ষ করে সোল্লাসে দয়াময় বন্দনায় মুখর হয়েছিল দেশের মানুষ। পরক্ষণেই পূর্ব দিগন্তে টুপ করে লাফ দিয়ে উঠে এসেছিল বরুণদেব। সূর্য, চন্দ্র আর তারকা একত্রে ধেয়ে গিয়েছিল গগনপথে।
ইউরোপে যখন এ দৃশ্য দেখা গেল, তখন সূর্যের অনেক কাছে চলে এসেছে আগন্তুক তারকা। সটান সূর্যের দিকেই ছুটছে নক্ষত্র–আস্তে আস্তে কমছে গতিবেগ–তারপর থেমেও গেল একসময়ে–সূর্য আর তারকা এক হয়ে গেল। মাথার ওপর খ-বিন্দুতে এসে। চাঁদ সরে এল তারকার বুক থেকে–গ্রহণের কাজ ফুরিয়েছে–আকাশ ঝকঝকে হয়ে ওঠায় চাঁদকে আর দেখাও যাচ্ছে না। ব্যাপারটা বোঝা গেল এতক্ষণে। পৃথিবীর খুব কাছে এসেও কাছাকাছি থাকতে পারল না রাক্ষুসে তারকা। পৃথিবীর পাশাপাশি থেকে কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করেও পৃথিবীর নাগাল ধরতে পারল না আকাশের আতঙ্ক। সূর্য তাকে টেনেছে। তাই সটান ধেয়ে যাচ্ছে সূর্যের জঠর লক্ষ্য করে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল পৃথিবীর মানুষ।