তাই ঘুম এল না কারও চোখে। ভিড় করে দাঁড়িয়ে রইল ছাদে, রাস্তায়, জাহাজের ডেকে। এক-এক সেকেন্ডে জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড পেরিয়ে আসছে কয়েকশো মাইল। গণিত গুরুর ভবিষ্যদ্বাণী আর কারও অজানা নেই। আগন্তুকের লক্ষ্য সূর্য। নেপচুনকে কোলে নিয়ে মহাবেগে সোজা ছুটছে সূর্যের দিকে। পৃথিবীর কয়েক লক্ষ মাইল দূর দিয়ে বেরিয়ে যেত, যদি না বৃহস্পতির টলটলায়মান অবস্থা না দেখা যেত। সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি। তার পাশ দিয়েই আসতে হবে আগন্তুককে। প্রচণ্ড আকর্ষণের ফলে কক্ষ্যচ্যুতি ঘটবে বৃহস্পতির–উপবৃত্তের আকার নেবে কক্ষপথ। নতুন তারাও সোজা পথ থেকে একটু বেঁকে গিয়ে ছুটবে সূর্যের দিকে যাওয়ার পথে হয় আছড়ে পড়বে পৃথিবীর ওপর, নয়তো এত গা ঘেঁষে যাবে যে, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, জলপ্লাবন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সাইক্লোন মিলেমিশে মহাপ্রলয় ডেকে আনবে পৃথিবীর বুকে।
গণিত-গুরুর এহেন ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়ে তুলতে যাচ্ছে মাথার ওপর ওই শীতল জ্বলন্ত একক তারকা।
সারারাত চেয়ে থেকে যারা চোখ টনটনিয়ে ফেলল, তারা কিন্তু স্পষ্ট দেখল, শনৈঃ শনৈঃ এগচ্ছে দুরন্ত তারকা। আবহাওয়াও পালটে গেল সেই রাতেই। মধ্য ইউরোপ, ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের বরফ নরম হয়ে এল বাতাস গরম হয়ে ওঠায়।
গণিত-গুরুর কথা কিন্তু সবাই মেনে নিতে পারেনি। পৃথিবীর সব মানুষ ভয়ে কাঠ হয়ে থাকেনি। প্রতি দশজনের মধ্যে একজন উৎকণ্ঠিত থেকেছে–বাকি নজন স্বাভাবিক জীবনযাপন করে গেছে–আকাশের উৎপাত নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এক হাজার সালেও নাকি এমনি উদ্ভট ভবিষ্যদ্বাণী শোনা গিয়েছিল। তারপরেও অনেকে এমনি বুক-কাঁপানো শেষের সেদিনের বার্তা শুনিয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। এখনও কিছু হবে না। যে আসছে, সে নক্ষত্র নয়–নিছক ধূমকেতু, গ্যাসের পিণ্ড। নক্ষত্রও যদি হত, পৃথিবীকে ধাক্কা মারতে তার বয়ে গেছে। সুতরাং আজগুবি তত্ত্বকথা নিয়ে বেশির ভাগ মানুষই বাজে সময় নষ্ট করতে চাইলে না। তাচ্ছিল্য করল গণিত-গুরুর সাবধানবাণীকে। ডুবে রইল যে যার কাজে। এমনকী অপরাধীমহলও আবার তৎপর হল অপরাধ অনুষ্ঠানে। দু-একটা কুকুরের ডাক ছাড়া পশুজগৎও মাথা ঘামাল না নতুন তারাকে নিয়ে।
গণিত-গুরু বলেছিল, সেই রাতেই গ্রিনউইচ সময়ের ৭টা ১৫ মিনিটে, বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছে আসবে নতুন তারা।
সন্ধে হল। যথাসময়ে আগন্তুককে দেখা গেল ইউরোপের আকাশে। এক ঘণ্টা পরেও আকার বাড়ল না তার। শুরু হয়ে গেল হাসি আর টিটকিরি। হায়! হায়! গণিত-গুরুর এত অঙ্ক শেষে বৃথাই গেল! বিপদ তো কেটে গেছে, দেখাই যাচ্ছে।
তারপরেই মিলিয়ে গেল হাসি। আবার বাড়ছে তারার আকার। আগের চাইতেও দ্রুত। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বড় হচ্ছে ঘণ্টায় ঘন্টায়। থেমে থাকার কোনও লক্ষণই নেই। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঔজ্জ্বল্য। মাথার ওপর খ-বিন্দুতে আসার পর যেন দিনের আলো ছড়িয়ে গেল মর্তে। বৃহস্পতির টানে বাঁকা পথে না এলে পাঁচ দিনের পথ একদিনেই ছুটে আসত। বাঁচিয়ে দিয়েছে বৃহস্পতি। কিন্তু এখন? পরের রাতেই ইংরেজরা দেখলে, চাঁদের তিন ভাগের এক ভাগ আয়তন নিয়েছে আগন্তুক তারা, বরফ গলে যাওয়া আর চোখের ভুল নয় –ঘটনা। আমেরিকার আকাশে নতুন তারা আবির্ভূত হতেই আঁতকে উঠল দেশের লোক। সর্বনাশ! এ যে চাঁদের মতোই বড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু চাঁদের মতো ঠান্ডা তো নয়। গনগনে সাদা চোখ মেলে চেয়ে থাকাও যাচ্ছে না। নিদারুণ উত্তাপে গরম বাতাস ঝড়ের মতোই বইতে শুরু করেছে এর মধ্যেই। ভার্জিনিয়া, ব্রাজিল আর সেন্ট লরেন্স উপত্যকায় শুরু হয়ে গেল বজ্রবিদ্যুৎ, শিলাবৃষ্টি। মানিকতাবায়ে বরফ গলে গিয়ে শুরু হল বন্যা। চিরতুষার গলতে শুরু করল পৃথিবীর সব কটা উঁচু পাহাড়ে। বরফ-গলা জল গাছ-পশু-মানুষ ভাসিয়ে নেমে এল সমতলভূমির দিকে নদীগুলোর দুকূল ছাপিয়ে–প্রাণ নিয়ে ছুটল সমতলের মানুষ।
আর্জেন্টিনা থেকে দক্ষিণ আটলান্টিক উপকূল বরাবর জলোচ্ছ্বস এত উঁচুতে ঠেলে উঠল, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। বহু জায়গায় প্রবল ঝড় ঠেলে নিয়ে গেল জলকে ভূখণ্ডের অনেক ভেতর পর্যন্ত–ডুবিয়ে দিল শহরের পর শহর। দারুণভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেল রাত্রে। ফলে, সকালবেলার সূর্যকে মনে হল যেন নিছক একটা ছায়া। শুরু হল ভূমিকম্প। বেড়ে চলল পলকে পলকে। শেষকালে আমেরিকা থেকে আরম্ভ করে মেরুবৃত্ত হয়ে কেপ হন পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলের প্রতিটি পাহাড়-পর্বতে ধস নামল, মাটি চৌচির হয়ে ফেটে গেল, বাড়িঘরদোর ধূলিসাৎ হল। কোটোপাক্সির পুরো পাশটা দুমড়ে-মুচড়ে যেন বিষম যন্ত্রণায় পিছলে যাওয়ার ফলে তোড়ে বেরিয়ে এল লাভাস্রোত, ঠেলে উঠল অনেক উঁচুতে এবং বিশাল অঞ্চল জুড়ে বেগে ধেয়ে গিয়ে একদিনেই পৌঁছে গেল খোলা সমুদ্রে।
নিবু নিবু অবস্থায় চাঁদ যখন উঁকি দিল আকাশে, আগন্তুক তারার দাপট তখন চলেছে গোটা প্রশান্ত সাগরীয় অঞ্চলে। পেছনে টেনে আনছে ঝড়বিদ্যুৎকে। সেই সঙ্গে উত্তাল হয়ে উঠছে জলরাশিফঁসে উঠে জলোচ্ছ্বাসের আকারে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একটার পর একটা দ্বীপে মানুষশূন্য করে ছাড়ছে প্রতিটি দ্বীপকে। চোখধাঁধানো দ্যুতি যখন অসহ্য হয়ে উঠেছে, যখন গরমে চামড়া পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে, যখন মনে হচ্ছে, লক্ষ চুল্লি জ্বলছে আকাশে-বাতাসে–তখন পঞ্চাশ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস গজরাতে গজরাতে নারকীয় ক্ষুধা নিয়ে আছড়ে পড়ল এশিয়ার সুদীর্ঘ উপকূলের ওপর এবং অগ্নিনিঃশ্বাসের মতো ঝড়ের ঠেলায় ভীমবেগে ঢুকে পড়ল চীন দেশের সমতলভূমিতে। সূর্যের চাইতেও বিরাট আর জ্বলন্ত হয়ে উঠেছে তখন আগন্তুক তারকা, সূর্যের চাইতেও লেলিহান এবং তপ্ত মুহূর্তের জন্য প্রলয়ংকর সেই রূপ দেখল চীনের মানুষ। দেখল প্যাগোডা, মহীরুহ, রাস্তা, চাষের মাঠ থেকে আকাশের আতঙ্ক আকাশ পুড়িয়ে ধ্বংস করে চলেছে বিশাল চীন। দেশকে–অন্য কোনও দেশে এত মানুষ নেই, যা আছে চীন দেশে। দেশসুদ্ধ মানুষের ঘুম উড়ে গেল চোখ থেকে। আকাশের বিভীষিকা ক্ষণেকের জন্যে দেখে আঁতকে উঠতেই-না উঠতেই চাপা গজরানির শব্দে রক্ত জল হয়ে গেল প্রত্যেকের–এল প্রবল জলোচ্ছাস। পালিয়ে যাবে কোথায়? উত্তাপে চামড়ায় ফোঁসকা পড়ছে, তপ্ত বাতাস নিঃশ্বাসের সঙ্গে নেওয়ায় ফুসফুস জ্বলে যাছে, তারপরেই ওই কালান্তক জলোচ্ছ্বাস-পঞ্চাশ ফুট উঁচু। এল অতর্কিতে, মৃত্যু ঢেলে দিয়ে গেল আচম্বিতে। নিষ্প্রাণ হয়ে গেল চীন দেশ।