দুপায়ে খাড়া হওয়ার চেষ্টা করেছিল ফোদারিনগে। অত কি সোজা? ঝড়ে মাথা মুড়িয়ে পরক্ষণেই আছড়ে ফেলেছিল মাটিতে। অগত্যা গোরু-ছাগলের মতো অতিকষ্টে, চার হাত পায়ে ভর দিয়ে কোনওমতে দেহ-উত্থান ঘটিয়েছিল ফোদারিনগে। কোটখানা তখনও পতপত করে উড়ছে মাথার ওপর দিয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে অনেক কায়দা-কসরত করে দুটি চালনা করেছিল আকাশপানে বিধুমুখী অভিমুখে। এবং, আবার স্বগতোক্তি জাগ্রত হয়েছিল বিমূঢ় কণ্ঠে, সাংঘাতিক একটা গোলমাল হয়ে গেছে কোথাও-না-কোথাও। কী সেই গোলমালটা, সেইটাই যে কচুপোড়া মাথায় আসছে না।
যেদিকে দুচোখ যায়, দেখা যাচ্ছে কেবল প্রলয়ংকর প্রভঞ্জনের দাপটে ধাবমান সাদা ধুলোর কুয়াশা। ঝড় যে এমন রক্ত জল-করা হুংকার ছাড়তে পারে, তা-ও কি ছাই জানা ছিল? এ কী সৃষ্টিছাড়া পেটের মধ্যে হাত-পা ঢুকিয়ে-দেওয়া চেঁচানি! রক্ত যে ঠান্ডা হয়ে গেল। সাদাটে ধুলোর ধাবমান পরদার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে শুধু পাকসাট-খাওয়া মৃত্তিকা স্তূপ আর লন্ডভন্ড ধ্বংসস্তূপ। গাছ নেই, বাড়ি নেই, চেনাজানা কোনও আকারই চোখে পড়ছে না, দিগন্তবিস্তৃত শুধু ধু ধু লন্ডভন্ডতা, বহু দূরে বিলীন হয়েছে ঘূর্ণমান ধুলোস্তম্ভ আর জলস্তম্ভের নিচেকার রক্ত-জমানো নিরেট নিঃসীম তমিস্রার গভীরে। নারকীয় এই দক্ষযজ্ঞ কাণ্ডকারখানার ঠিক ওপরেই অট্টরোলে ফেটে পড়ছে বজ্র, চোখের স্নায়ু ঝলসে দিচ্ছে অতিতীব্র বিদুৎ। ঝড়ের বেগ কিন্তু বেড়েই চলেছে পলকে পলকে। খুব কাছেই পাটকাঠির মতো পটপট করে ভেঙে-যাওয়া একটা গাছ চলেছে গড়িয়ে গড়িয়ে–একটু আগেই যাচ্ছিল বিশাল মজবুত এম মহীরুহ। তারও ওপাশে দলা-পাকানো একটা ইস্পাত-ফ্রেম ঠিকরে ঠিকরে উঠছে মাটি থেকে।
ব্যাপারটা অবশ্যই অস্বচ্ছ নয় আপনার কাছে। ফোদারিনগে তো কোটের বোতাম এঁটে নিয়ে দরাজ গলায় পৃথিবীর আবর্তন বন্ধ করার হুকুম দিয়েই খালাস, ভূপৃষ্ঠের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সঞ্চরমাণ বস্তুগুলোর অবস্থা যে কী হবে, অর্ডার দেওয়ার আগে সেই হিসেবটা মনে মনে কষে নিলেই তো এই মহাপ্রলয়টা ঘটত না। বসুন্ধরা এমনিতেই ভীষণ বেগে পাক খেয়ে চলেছে, ভগবানের লাটুও বলা যায়। নিরক্ষরেখা বরাবর ভূপৃষ্ঠের গতিবেগ ঘণ্টায় হাজার মাইলেরও বেশি। অক্ষাংশ অঞ্চলে তার অর্ধেকেরও বেশি। ফলে, সেকেন্ডে প্রায় নমাইল বেগে সামনের দিকে আচমকা ঠিকরে গেছেন মি. মেডিগ–সেই সঙ্গে গোটা গ্রামটা, ফোদারিনগে স্বয়ং এবং আশপাশের সবকিছুই। সেকেন্ডে নমাইল বেগে ধেয়ে যাওয়া মানেটা কী, তা অবশ্যই অজানা নয় আপনার কাছে, কামান থেকে নিক্ষিপ্ত গোলারও ক্ষমতা নেই অত জোরে ছুটে যাওয়ার! আচমকা এই ভয়াবহ গতিবেগ অর্জন করে বসেছে অঘটনবাজ মানুষ দুটি আশপাশের সবকিছু সমেত। আছড়ে পড়ছে বাড়িঘরদোর, মানুষ, পশুপাখি–পড়ছে আর পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হচ্ছে! গড়িয়ে থেঁতলে পিণ্ডি পাকিয়ে নিমেষে নিমেষে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মহাপ্রলয় বলে একেই। চোখ দিয়ে দেখে মন দিয়ে বোঝবারও সময় দিচ্ছে না।
বলা বাহুল্য, পরিস্থিতিটা মোটেই মনঃপূত হয়নি মি. ফোদারিনগের। মির্যা ঘটাতে গিয়ে মহাপ্রলয় ঘটানো হয়ে গেছে–এই চৈতন্যটা বড়ই পীড়াদায়ক হয়েছিল সেই মুহূর্তে। রুদ্র প্রকৃতির করাল রূপ হাড়ে দুব্বো গজিয়ে দিয়েছিল বললেই চলে এবং দুচক্ষের বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাবৎ মির্যাল কাণ্ডকারখানা। ছ্যা ছ্যা! এই যদি মিরাকল হয়, তাহলে সে মিরাকলের দরকারটা কী বাপ? কালো আলকাতরার মতো অন্ধকারে দৃষ্টিও আটকে যাচ্ছে–মওকা বুঝে রাশি রাশি মেঘ দঙ্গল বেঁধে ঢেকে দিয়েছে চাঁদের মুখ। কান আর সইতে পারছে না ক্রমবর্ধমান ঝড়ের হুহুংকার। মেঘ আর ঝড়ে কুস্তি চলছে সমস্ত আকাশ জুড়ে, রণে ভঙ্গ দেওয়ার পাত্র নয় কেউই। পাঁক, জলের ছিটে আর ধুলোয় সর্বাঙ্গ ঢেকে যাচ্ছে কেন দেখবার জন্যে চোখে হাত ঢাকা দিয়ে সেইদিকে চোখ ফিরিয়েই আঁতকে উঠেছিল ফোদারিনগে।
দেখেছিল, বিশাল উঁচু একটা জলের পর্বত ভেঙে পড়তে চলেছে ঠিক তার মাথার ওপরেই!
চেঁচিয়ে উঠেছিল বিকট গলায় (যদিও প্রাকৃতিক শক্তিবর্গের সম্মিলিত হুংকারধ্বনির তুলনায় তা মনে হয়েছিল মিনমিনে ভাঙা স্বর)–মেডিগ? কোথায় আপনি?
জল প্রায় মাথার ওপর!
থাম! থেমে যাও বলছি!
থেমে গিয়েছিল ঝুলে-পড়া জলরাশি।
বজ্র আর বিদুৎকে ধমকে উঠেছিল ফোদারিনগে, দাঁড়াও-না বাপু, ইয়ারকিটা একটু বন্ধ রাখ–ভাববার সময়টা অন্তত দাও!
থেমে গিয়েছিল বজ্রপাত এবং বিদ্যুঝলক।
কী করা যায় এখন? লর্ড! করবটা কী? মেডিগ যদি থাকত ধারেকাছে!
ঠিক হ্যায়, বুদ্ধি খুলে গিয়েছিল ফোদারিনগের–এবার ভুল হবে না। ঠিক অর্ডারটাই দেওয়া যাক।
চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে, ঝোড়ো হাওয়ায় পিঠ দিয়ে মনে মনে ঝড়ের মতোই ভেবে নিয়েছিল আবার সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পন্থাটা।
বলেছিল, পেয়েছি!… চালাও! না-বলা পর্যন্ত আমার হুকুমমতো যেন আর কিছু না ঘটে!… লর্ড! আগে কেন মাথায় আসেনি বুদ্ধিটা? ঝড়ের গোঙানি ছাপিয়ে ষাঁড়ের মতো গলাবাজি শুরু করেছিল ফোদারিনগে। ভয়াবহ ওই ঝড়ের আওয়াজকে কি চেঁচানি দিয়ে টেক্কা মারা যায়? নিজের কণ্ঠস্বরই শুনতে পায়নি অঘটনবাজ মানুষটা। তা-ই বলে ভাটাও পড়েনি গলাবাজিতে–শোন হে, শোন, আমার হুকুমগুলো এবার কান খাড়া করে শুনে যাও! আর যেন ভুল হয় না এক চুলও। প্রথমেই বলে রাখি, আমার কথামতো সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর, আমার এই অলক্ষুনে অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর শক্তি যেন একেবারেই লোপ পায়, আর পাঁচজনের ইচ্ছাশক্তির মতোই যেন হয়ে যায় আমার ইচ্ছাশক্তি, এবং এই সমস্ত বিপজ্জনক মির্যাকল যেন পত্রপাঠ বন্ধ হয়ে যায়। জঘন্য মির্যাল–দুচক্ষের বালি। না ঘটালেই হত–আহাম্মকি যা হবার তা হয়ে গেছে, আর নয়, ঢের হয়েছে। আমার দ্বিতীয় হুকুমটা এই: মির্যা শুরু হওয়ার আগে যেখানে যেভাবে ছিলাম, ঠিক সেইখানে, সেইভাবে ফিরে যেতে চাই। শুধু আমি নয়–হতচ্ছাড়া পাজির পা-ঝাড়া ওই লম্ফটা উলটে যাওয়ার আগে যেখানে যে অবস্থায় যা কিছু ছিল–সমস্ত ঠিক সেই সেই জায়গায় সেই সেই অবস্থায় ফিরে যাক। বিরাট কাজ বুঝছি, কিন্তু এই তো শেষ। মাথায় ঢুকেছে? না, আর কোনও মির্যাকূলের দরকার নেই। ঠিক যা ছিল তা-ই হয়ে যাক। সবকিছুই আগের মতো হয়ে যাক। লং ড্রাগনে আধ পাঁইট গেলবার আগে যেমনটি ছিল– হুবহু সেইরকম। বাস, আর কোনও হুকুম নেই!