তৃতীয় দিনে পৃথিবীর সব মানুষকে সজাগ করে দিলে খবরের কাগজগুলো। মহাশূন্যের এই প্রেতচ্ছায়াকে আর উপেক্ষা করা যায় না। লন্ডনের একটা দৈনিক লিখল, খুব সম্ভব
নেপচুন গ্রহকে ধাক্কা মারতে চলেছে মহাকাশের আগন্তুক। তেসরা জানুয়ারি সূর্যাস্ত হতেই পৃথিবীর মানুষরা আকাশপানে চেয়ে রইল আসন্ন সংঘাতের আশঙ্কায় শিহরিত অন্তরে।
লন্ডনের রাস্তাঘাট থেকে দেখা গেল একটা বিশাল সাদা তারা–দেখা গেল সমুদ্র থেকেও। আচমকা পশ্চিম আকাশে উঠে এসেছে নবাগত নক্ষত্র!
সন্ধ্যাতারার চাইতেও উজ্জ্বল নক্ষত্র। মিটমিটে আলোককণা নয়–পরিষ্কার চাকাঁপানা দেহ। সারারাত ধরে বড় হচ্ছে আকার। ভোরের দিকে হল আরও স্পষ্ট। বিজ্ঞান যার বৃত্তান্ত জানে না, সাধারণ মানুষ তার এই চেহারা দেখে আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেল। না জানি আবার কী মহামারী আর মহাযুদ্ধ নিয়ে এল এই উৎপাত। বুয়র, হটেনটট, নিগ্রো, ফরাসি, স্প্যানিয়ার্ড, পর্তুগিজ প্রত্যেকেই ভোরের আলোয় স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল অদ্ভুত নতুন নক্ষত্রের দিকে।
সংঘর্ষটা লাগল তারপরেই। বহু দুরের দুটি জ্যোতিষ্ক কাছাকাছি হয়েই মিশে গেল। একসঙ্গে। রুদ্রতেজের ঝলক সূচনা করল নেপচুন গ্রহের মৃত্যু। আগন্তুক গ্রহের ধাক্কায় দুই জ্যোতিষ্ক তালগোল পাকিয়ে আরও বিরাট নক্ষত্রের আকারে ঢলে পড়ল পশ্চিমের আকাশে পূর্বে সূর্য ওঠার আগেই। দূর সমুদ্রের নাবিকরা দেখল, আচমকা আকাশে উঠে এল এক নয়া চাঁদ–স্থির হয়ে ভেসে রইল মাথার ওপররাত ফুরালেই ঢলে পড়ল পশ্চিমে। ক্যামেরা আর স্পেকট্রোস্কোপে ধরে রাখা হল সেই দৃশ্য।
ইউরোপের আকাশে নবাগতকে দেখেই আঁতকে উঠল আপামর মানুষ। আকারে আরও বড়–গতকালের চাইতেও। সাদা আগুনের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে সামনে। পশ্চিমের চাঁদও সে তুলনায় নিষ্প্রভ। প্রতিটি ছাদ আর পাহাড় থেকে দেখা গেল তাকে।
মানমন্দিরের বৈজ্ঞানিকরা দেখল আরও ভয়ংকর ঘটনা। বিচিত্র নতুন তারা শুধু
আকারেই বড় হয়নি–আরও কাছে এগিয়ে আসছে! টেলিগ্রাম মারফত বিদ্যুৎ বেগে খবর ছড়িয়ে গেল তামাম দুনিয়ায়। রহস্যময় আগন্তুক এগিয়ে এসেছে পৃথিবীর অনেক কাছে। মাঠে-ঘাটে-হাটেও দেখা গেল, সত্যিই অনেক কাছে চলে এসেছে নবাগত হানাদার!
সন্ধে নামল। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দেখা গেল আকাশের আতঙ্ককে–যেন একটা হলদে প্রেত–চাঁদের মতো সাদা ঝকঝকে নয়। সূর্য ডুবেছে, অথচ আকাশ আলোয় আলো হয়ে রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এক বড়লোক রাস্তায় আলোর মালা ঝুলিয়েছিল বিয়ে উপলক্ষে। আকাশের আলো দেখে হতবাক হল সে। খুশিও বটে। আকাশেও আলো ঢেলে দিয়ে গেল নতুন তারা।
গণিত-গুরু কাগজপত্র সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তাঁর নিজস্ব ঘরে। চার রাত ওষুধ খেয়ে জেগে থেকেছেন–শুধু অঙ্ক কষে গেছেন। হিসেবে তাঁর ভুল হয়নি। সাদা শিশির মধ্যে এখনও একটু ওষুধ পড়ে রয়েছে–কিন্তু আর রাত জাগার দরকার হবে কি? হিসেব ঠিকই আছে। পৃথিবীর শেষ দিন। ঘনিয়ে এল বলে।
উঠে দাঁড়ালেন গণিত-গুরু। জানলার সামনে গিয়ে খড়খড়ি তুলে চেয়ে রইলেন চিমনি আর বাড়ির ছাদের ওপর ঝুলন্ত তারার দিকে।
চেয়ে রইলেন নির্নিমেষে। অকুতোভয় সৈনিক যেন নিরীক্ষণ করছেন বিষম বৈরীকে। চোখের পাতা ফেললেন না বেশ কিছুক্ষণ। তারপর নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করে বললেন নিজের মনে, হত্যা তুমি করতে পার আমাকে–কিন্তু তোমাকে আর এই গোটা ব্ৰহ্মাণ্ডটাকে এই মাথার মধ্যে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার আছে। ছোট্ট এই মস্তিষ্কে বন্দি রইলে তুমি।
পরের দিন কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দুপুরবেলা ঢুকলেন ক্লাসঘরে। তুলে নিলেন একটা চকখড়ি। এটা তাঁর মুদ্রাদোষ। চকখড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া না করলে বক্তৃতা দিতে পারেন না। ছাত্রছাত্রীরা একবার সে এক্সপেরিমেন্ট করে খুব মজা পেয়েছে। আজ কিন্তু তাঁর মুখচ্ছবি দেখে থমথম করতে লাগল গোটা ক্লাস। চকখড়ি নাড়তে নাড়তে বললেন গণিত-গুরু, যা পড়াব ঠিক করেছিলাম, তা আর শেষ করতে পারব না। কারণ, মানুষ জাতটা বৃথাই এসেছিল পৃথিবীতে সংক্ষেপে, এই আমার আজকের বক্তৃতা।
বিমূঢ় ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারটা প্রাঞ্জল করে দিয়েছিলেন অচিরেই ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক কষে।
সেই রাতেই আরও বৃহৎ, আরও স্পষ্ট, আরও ঝকঝকে হয়ে উঠল নতুন তারা। একটু দেরিতেই আবির্ভূত হল আকাশে। দ্যুতিময় নীলচে হয়ে উঠল কালো আকাশ। আলোর দাপটে একে একে অদৃশ্য হয়ে গেল লিও প্রমুখ অনেক নক্ষত্র–বৃহস্পতিকেই কেবল দেখা গেল মাথার ওপর। নবাগতের চারধারে জ্যোতির্বলয়ের মতো নিষ্প্রভ আলোকচ্ছটা। নিরক্ষীয় অঞ্চলের পরিষ্কার আকাশে তার আয়তন চাঁদের আয়তনের চার ভাগের এক ভাগ। ইংল্যান্ডের মাটি ছুঁয়ে রয়েছে কুয়াশা তখনও–কিন্তু গোটা পৃথিবী উদ্ভাসিত হল অত্যুজ্জ্বল চাঁদের আলোয়। শীতল পরিষ্কার আলোয় স্পষ্ট পড়া গেল ছাপা হরফ। হলদে ম্যাড়মেড়ে হয়ে উঠল শহরের বাতিগুলো।
জেগে রইল তামাম দুনিয়ার মানুষ। গির্জায় গির্জায় বাজল ঘণ্টা, দেবালয়ে উপাসনালয়ে শুরু হল প্রার্থনা–অনেক পাপ করেছ পৃথিবীর মানুষ, আজ রাতে আর ঘুমিয়ো না, আর পাপ করো না। এসো, বন্দনা কর নতুন তারাকে। নতুন তারা তখন মুহূর্তে মুহূর্তে আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে–ভীমবেগে ধেয়ে আসছে যেন পৃথিবীর দিকেই।