তাই ফিরে এসেছিল গানবোট। অনেকটা পথ এসে তীরভূমিতে কবরস্থ করা হয়েছিল দা কুনহাকে।
এমন একটা জায়গায়, যেখানে নতুন শ্রেণির এই পিঁপড়েরা এখনও পৌঁছায়নি।
তিন হপ্তা আগে টুকরো টুকরোভাবে পুরো বিবরণটা শুনেছিলাম হলরয়েডের মুখে।
বিশেষ এই পিঁপড়েদের মস্তিষ্ক আছে। আর দেরি করা উচিত নয়। মহাবিপদ আসন্ন বদ্ধমূল এই ধারণা নিয়েই ইংল্যান্ডে ফিরেছেন হলরয়েড। বুদ্ধিমান এই পিপীলিকাবাহিনী আপাতত যেখানে সক্রিয়, ব্রিটিশ গুয়ানা সেখান থেকে এক হাজার মাইলের মধ্যেই। কাজেই এখন থেকেই হুঁশিয়ার না হলে ব্রিটিশ গুয়ানার যে কী হাল হবে, তা ভাবতেও গায়ের রক্ত জল হয়ে যাচ্ছে তাঁর।
নারকীয় এই কীটদের যে আর উপেক্ষা করা সমীচীন নয়, ব্রাজিল সরকার তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে পাঁচশো পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেছে মোক্ষম কীটনাশকের জন্যে। মাত্র তিন বছর আগে অজেয় এই কীট আবির্ভূত হয়েছিল অনতিদূরে পাহাড়ের ওপরে। এর মধ্যেই তাদের বিজয়-অভিযান রীতিমতো বিস্ময়কর। বাতেমো নদীর দক্ষিণ তীরভূমির প্রায় ষাট মাইল জায়গা তাদের পুরো দখলে। মানুষকে একেবারেই তাড়িয়ে ছেড়েছে, অথবা খতম করেছে। জায়গা-জমি, বাড়িঘরদোর, কলকারখানায় ঘাঁটি গেড়েছে।
একটা জলপোতও দখলে এনে ফেলেছিল। অব্যাখ্যাত পন্থায় কাপুয়ানা শাখানদীর ওপর সেতু রচনা করে অ্যামাজনের ভেতরে বহু মাইল পথ নাকি এগিয়ে এসেছে। সাধারণ পিঁপড়েদের মতো তারা নয়, ঢের বেশি সংঘবদ্ধ এবং সমাজবদ্ধ। অন্য পিঁপড়েদের সমাজ বিক্ষিপ্ত, কিন্তু এরা একত্র হয়ে একটা জাত গড়ে তুলেছে। বুদ্ধিমত্তার শেষ এখানেই নয়, ভয়াবহতা প্রকটতর হয়েছে বিষপ্রয়োগের নৈপুণ্যে। বৃহদাকার শত্রুকে বল প্রয়োগে বধ করে না–করে বিষপ্রয়োগে। বিষটা সাপের বিষের মতোই মারাত্মক। খুব সম্ভব উৎপাদনও করে নিজেরা। ওদেরই মধ্যে আয়তনে যারা বড়, তারা ছুচের মতো তীক্ষ্ণাগ্র ক্রিস্টাল বয়ে নিয়ে যায় মানুষের মতো বড় শত্রুদের গায়ে বিঁধিয়ে দেওয়ার জন্যে।
বিশ্ববাসীকে সজাগ করার মতো বিশদ বিবরণ এখনও পাওয়া যায়নি। চাক্ষুষ বর্ণনা পাওয়া গেছে কেবল হলরয়েডের কাছ থেকেই। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে যেটুকু বলেছেন, চমৎকৃত এবং হুঁশিয়ার হওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট। ঊর্ধ্ব অ্যামাজনে ক্রমশ কিংবদন্তির আকারে ছড়িয়ে পড়ছে অসাধারণ এই পিঁপড়েদের অত্যাশ্চর্য কীর্তিকলাপ–কল্পনার আতঙ্ক মিশ্রিত হওয়ার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানারকম অতিরঞ্জিত কাহিনি। বিচিত্র এই পোকারা নাকি বিবিধ হাতিয়ারের ব্যবহার জানে, আগুনের ব্যবহার জানে, ধাতুর ব্যবহার জানে, যন্ত্রবিদ্যাও জানে। তাই পারাহাইবার নদীর তলায় সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ফেলেছে অদ্ভুত কৌশলে লন্ডনের টেমস নদীর মতোই চওড়া সেই নদী অতিক্রম করেছে পাতাল-বিবর দিয়ে। তাদের জ্ঞানবুদ্ধি সঞ্চিত থাকে মানুষের মতোই পুঁথি আর নথির মধ্যে–সঞ্চিত বিদ্যেকে কাজে লাগায় প্রয়োজনমতো। আপাতত তারা শুধু অগ্রসর হচ্ছে বিরামবিহীনভাবে এবং পথে মানুষ পড়লেই খতম করে দিচ্ছে নির্দয়ভাবে। বংশবৃদ্ধিও ঘটছে দ্রুতহারে। হলরয়েডের ধ্রুব বিশ্বাস, অচিরেই পুরো নিরক্ষীয় দক্ষিণ আমেরিকা এসে যাবে তাদের আধিপত্যে।
কিন্তু শুধু দক্ষিণ আমেরিকাতেই বিজয়কেতন উড়িয়ে তারা ক্ষান্ত হবে, এমন কথা কে বলতে পারে? যে গতিবেগে এগচ্ছে, ১৯১১ সাল নাগাদ হানা দেবে কাপুয়ারানা এক্সটেনশন রেলপথে–ইউরোপের ধনকুবেরদের টনক নড়বে তখনই।
১৯২০ নাগাদ পেরিয়ে আসবে অ্যামাজনের অর্ধেক। আমার তো মনে হয়, ১৯৫০ কি ১৯৬০-এর মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলবে ইউরোপকে।
প্রলয়-তারার ধ্বংসলীলা
প্রলয়-তারার ধ্বংসলীলা (The Star)
[‘The Star’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The Graphic’ পত্রিকায় ডিসেম্বর ১৮৯৭ সালে। ‘Doubleday & McClure Co.’ থেকে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ‘Tales of Space and Time’ সংকলনটিতে গল্পটি স্থান পায়। জুন ১৯২৬ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়।]
সূর্যকে প্রদক্ষিণরত গ্রহদের মধ্যে দূরতম গ্রহ নেপচুন যে হঠাৎ টলমল করে উঠেছে, এ খবর প্রথম প্রচারিত হল নতুন বছরের পয়লা তারিখেই। সব কটা মানমন্দির থেকেই প্রায় একই সঙ্গে জানানো হল, নেপচুনের গতিপথ আগের মতো আর নেই রীতিমতো টলটলায়মান! গতিবেগ যে কমে এসেছে, এরকম একটা সন্দেহের আভাস ডিসেম্বরেই দিয়েছিলেন ওগিলভি। বেশির ভাগ মানুষই খবরটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি–কেন-না নেপচুন গ্রহের অস্তিত্বের খবরই তারা রাখত না। অত দূরে ধূলিকণার মতো একটা আলোকবিন্দুর সহসা আবির্ভাবে নেপচুন গ্রহ চঞ্চল হয়েছে কেন, তা উত্তেজিত করেনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী যারা নয়, তাদের কাউকেই। চঞ্চল হয়েছিলেন কিন্তু বিজ্ঞানীরা। ছোট্ট আলোককণাটা দ্রুত বড় হচ্ছে, উজ্জ্বলতর হচ্ছে, অন্য গ্রহদের নিয়মমাফিক গতিপথের ধারকাছ দিয়েও যাচ্ছে না–সবই তাঁরা লক্ষ করেছিলেন। উপগ্রহ সমেত নেপচুনের কক্ষপথচ্যুতি এভাবে এর আগে কখনও ঘটেনি।
বিজ্ঞানে যাদের অনুশীলন নেই, সৌরজগতের বিশাল বিচ্ছিন্নতা তাদের কল্পনায় আসবে না। সৌরজগতের বাইরের মহাশূন্যতাও ধারণা করতে পারবে না। নেপচুনের পর যে ধু ধু শূন্যতা, তা দশ লক্ষ মাইলকে দুকোটি দিয়ে গুণ করলে যা দাঁড়ায়–তা-ই। এখানে আলো নেই, তাপ নেই, শব্দ নেই। নিকষ শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই। নিকটতম তারামণ্ডল রয়েছে। এরপরেই। মাঝেমধ্যে ক্ষীণতম অগ্নিশিখার মতো দু-একটা ধূমকেতু দেখা যায় এই বিপুল মহাশূন্যতার মধ্যে–এ ছাড়া এখানকার আর কোনও খবর রাখে না মানুষ। রহস্যময় এই কালো অঞ্চল থেকেই সহসা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আবির্ভূত হল এই আগন্তুক টহলদার। বিশাল বস্তুপুঞ্জ। কৃষ্ণরহস্য থেকে বেরিয়ে এসেই ধেয়ে চলল জ্বলন্ত সূর্যের দিকে। দ্বিতীয় দিনেই দূরপাল্লার যন্ত্রে দেখা গেল তাকে রেগুলাসের কাছে লিও তারামণ্ডলের পাশে। বিশাল ব্যাস। অল্পক্ষণের মধ্যেই মামুলি দূরবিনেও ধরা পড়ল তার চেহারা।